৩৩৫-৩৩৪ বিসিই গ্রীসের সিংহাসনে বসলেন আলেকজান্ডার। তার পিতা ছিলেন ২য় ফিলিপ, যিনি ৩৩৪ বিসিই তার মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত মেসিডোনিয়ার রাজা ছিলেন। এই মেসিডোনিয়া গ্রীসের অন্যতম প্রধান রাজ্য ছিল। আর এসময় এখানে সকল প্রকার শিল্পকলার বিকাশ ঘটেছিল এবং উৎকর্ষতা শিখরে পৌঁছেছিল। দর্শন, সাহিত্য, ভাস্কর্য, স্থাপত্য-শিল্প এবং অন্যান্য কলায় তারা সমসাময়িক অন্যান্য জাতিসমূহের তুলনায় শ্রেষ্টত্ব অর্জন করেছিল। এখানেই থুসিডাইডেস, অ্যারিষ্টফেনিস, জেনোফোন, সক্রেটিস, প্লেটো, এরিষ্টোটল, ডায়োজিনিস, ডিমোস্থিনিস এবং আরও অনেক মহৎ মহৎ লোকের জন্ম হয়েছিল। বিশ্ব বিজয়ী আলেকজান্ডার এরিষ্টোটলের ছাত্র ছিলেন।
আলেকজান্ডারকে পাঠদানরত এরিস্টোটল |
সাহিত্য ও শিল্পকলা গ্রীকদের জীবনে একটি বিরাট স্থান দখল করেছিল। বুদ্ধিগত বিকাশ সম্পর্কে সতর্ক ছিল বিধায়, তারা বিভিন্ন শিক্ষালয় স্থাপন করেছিল। তারা দর্শণশাস্ত্র নিয়ে আলাপ আলোচনা করত। শিল্পকলা এবং ভাস্কর্য শিক্ষার্থীদের জন্যে তাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। তাদের প্রত্যেকটি দালান কোঠায় আবশ্যিকভাবে কারুকার্য করা হত। এই কারুকার্য বা ভাস্কর্য প্রধানতঃ ছিল তাদের বিভিন্ন দেবদেবীদের নিয়ে। তাদের কাছে শিল্পকলাবিহীন একটি নগরী ছিল অচিন্ত্যনীয়। তারা তাদের ভাষাকে ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষায় পরিণত করেছিল।
প্রাচ্যের অন্যান্য জাতিসমূহ থেকে গ্রীকদের জীবন-যাপনের পদ্ধতি ও রীতিনীতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের। তাদের পোশাক ছিল জমকাল, ঢিলে-ঢালা এবং তারা চওড়া কান বিশিষ্ট টুপি মাথায় দিত। তাদের জীবন দর্শন ছিল এই ধরণের যে, জীবনকে আজই উপভোগ করতে হবে, আগামীকাল আমরা নাও থাকতে পারি। এই কারণে গ্রীকেরা ভোগ-বিলাসকে তাদের অন্যতম প্রধান বিষয় মনে করত। তদের কাছে ধর্ম ছিল ভবিষ্যৎ জীবনের বিষয় তাই তাদের চিন্তা-ভাবনায় এর স্থান ছিল সামান্য মাত্র।
আলেকজান্ডারের মূর্ত্তি, ইস্তাম্বুল। |
রাজা ২য় ফিলিপ তার শক্তিশালী সেনাবাহিনী দ্বারা একের পর এক গ্রীক শহর দখল করতে শুরু করলেন। গ্রীক দাস মালিকদের একাংশ স্বেচ্ছায় তার বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। জন্মভূমির স্বাধীনতার চেয়ে তারা বেশী মূল্য দিত নিজেদের ধন-সম্পত্তিকে। এমনও ঘটেছে যে, রাজা ফিলিপ কাউকে কিছু উৎকোচ দিয়েছেন, আর তারা পরে দূর্গের প্রবেশদ্বার তার জন্যে খুলে দিচ্ছে। এ করণে ফিলিপ ব্যঙ্গ করে বলতেন যে-‘সোনাভরা গর্দভ যে কোন শহর নিয়ে নিতে পারে।’
মেসিডোনিয় সম্রাটের বিরুদ্ধে এথেনিয় দেমোস উঠে দাঁড়িয়েছিল। আত্তিকা প্রদেশের শাসক অভিজাতবর্গ ব্যতিরেকে সমস্ত স্বাধীন এথেন্সবাসীদের বলা হয় দেমোস। এদের বেশিরভাগই ছিল কৃষক, কারিগর, মাঝিমাল্লা ও দিনমুজুর। যাহোক বিখ্যাত বাগ্মী ডিমোস্থিনিস তার জ্বালাময়ী বক্তৃতায় ২য় ফিলিপকে পরস্বাপহারী রূপে সকলের সম্মুখে প্রকাশ করেন এবং গ্রীকদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে আহবান জানান। এরফলে মধ্যগ্রীসের নগর রাষ্ট্রসমূহের একাংশ মেসিডোনিয়ার সাথে সংগ্রামের জন্যে ঐক্যবদ্ধ হয়।
মেসিডোনিয়া। |
এথেনিয় সেনাবাহিনী কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে গড়ে উঠেছিল। সেনাবাহিনীতে ভর্ত্তির সময় তরুণেরা শপথ নিত। তাদের শপথ ছিল এমন- ‘আমি এই পবিত্র অস্ত্রের অসম্মান করব না এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেখানেই থাকি, কখনই আমার সঙ্গীকে পরিত্যাগ করব না। আমি আমার পর্ণ কুঠির রক্ষার জন্যে যুদ্ধ করব এবং তারপরে পিতৃভূমিকে দূর্বল তো করবই না, বরং আরও পরাক্রান্ত ও শক্তিশালী করে তুলব। আমি নিজে অন্যদের সাথে বর্তমানে প্রচলিত আইন-কানুন এবং ভবিষ্যতে যেসব আইন-কানুন প্রবর্তিত হবে, সেসবও মেনে চলব। স্বদেশের সমুদয় পবিত্র বস্তুকে আমি ভক্তি করব। দেবতারা আমার সাক্ষী-সাক্ষী স্বদেশের সীমানা, গম ও যবের শস্য ক্ষেত, জলপাইয়ের বাগান ও দ্রাক্ষাক্ষেত।’
এথেনীয়দের দৃঢ় মনোবল ও নেতৃত্বের কারণে দীর্ঘদিন ধরে এই ভয়াবহ যুদ্ধ চলে। প্রথম দিকে ২য় ফিলিপের বাহিনীকে এথেনিয়রা পিছু হটিয়ে দেয়। অবশ্য উন্নততর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জ্বিত এবং অধিক নিয়ম শৃঙ্খলায় অভ্যস্ত মেসিডোনিয় সেনাবাহিনী জয়লাভ করেছিল। এই জয়লাভের ফলে প্রায় সমস্ত গ্রীস মেসিডোনিয়ার পদানত হয়।
আলেকজান্ডার বাল্যকাল থেকেই ইচ্ছে পোষণ করতেন যে, তিনি সিংহাসনে আরোহণের পর বিশ্ব জয়ের মত বিশাল এবং গৌরবময় কোন কার্য্য করবেন। গোর্দিউস নগরে একটি রথের উপরে ‘গোর্দিউস গিঁট’ অত্যন্ত জটিলভাবে জঁটপাকানো একটি গিঁট রাখা ছিল। কথিত ছিল যে, যিনি ঐ গিঁট খুলতে পারবেন তিনি সমগ্র এশিয়ার অধিপতি হবেন। অনেকেই গিঁট খুলতে চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু কেউই তা খুলতে পারেনি। আলেকজান্ডারও চেষ্টা করেন। অত:পর যখন ব্যর্থ হলেন, তখন তিনি তরবারী দ্বারা গিঁটটা কেটে ফেললেন। এ থেকেই এ বাগিধির উৎপত্তি: To cut the Gordian knot. অর্থাৎ জটিল ও গোলমেলে কোন সমস্যার দ্রুত চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা।
সুতরাং পিতা ২য় ফিলিপের এই বিজয়াভিযানের সাফল্য শুনে যুবক আলেকজান্ডার তাই বলেছিলেন, ‘আমার পিতাই সব অধিকার করে নেবেন দেখছি, বিরাট ও গৌরবময় কোন কিছু করার সুযোগ আর আমার কপালে বোধহয় নেই।’
Plutarch stated, Philip overjoyed at his courage and ambition, kissed his son and declared: "My boy, you must find a kingdom big enough for your ambitions. Macedon is too small for you",
Plutarch stated, Philip overjoyed at his courage and ambition, kissed his son and declared: "My boy, you must find a kingdom big enough for your ambitions. Macedon is too small for you",
সমস্ত গ্রীস নিজের অধিকারে নিয়ে আসার পর রাজা ২য় ফিলিপ পারস্য অভিযানের জন্যে তৈরী হতে লাগলেন। এই অভিযান প্রস্তুতি কালে চক্রান্তকারীদের হাতে নিহত হলেন তিনি। তখন তার ২০ বৎসর বয়স্ক পুত্র আলেকজান্ডার সিংহাসনে উপবেশন করলেন।
আলেকজান্ডার সিংহাসনে আরোহণের অল্পদিনের মধ্যে ৩০ হাজার পদাতিক ও পাঁচ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে বের হন দিগিজয়ে এবং অল্পদিনেই লক্ষ লক্ষ মানুষের এবং বহু জাতির ভাগ্যনিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। তিনি তার সংক্ষিপ্ত বার বৎসরের রাজত্বকালে যে বিশাল বিজয় অর্জন করেন তার পূর্বে অন্য কেউ সেরূপ করতে সক্ষম হননি।
ইসসুজের যুদ্ধ। |
যুদ্ধে সোরীয়রা পরাজিত হল। আলেকজান্ডার ছিলেন বদরাগী ও নিষ্ঠুর। তার বিরুদ্ধে যারা রূখে দাঁড়িয়েছে সেইসব জনগোষ্ঠীকে তিনি নির্মমভাবে হত্যা করেছেন নয়ত: তাদের দাসে পরিণত করেছেন। সোর নগরী আত্মসমর্পণে অস্বীকৃত হওয়ায় আলেকজান্ডার পুরো নগরী পুড়িয়ে ছারখার করে দেন। অত:পর নগরী দখল করার পর তার ৮ হাজার অধিবাসীকে হত্যা ও ৩০ হাজার অধিবাসীকে বন্দী করে বাজারে দাসরূপে বিক্রি করে দেন।
আলেকজান্দ্রিয়া নগরীর পত্তন। |
ফালাঙ্গোস। |
যুদ্ধের শুরুতে দারিয়াবস আক্রমণের জন্যে রথীদের পাঠালে গ্রীক বাহিনী শর নিক্ষেপ করে তাদের অধিকাংশকে নিহত করে ফেলে এবং নিজেরা দু‘পাশে সরে যাওয়া মাত্র পারস্যিকদের ক্ষিপ্তপ্রায় ধাবমান যুদ্ধাশ্বগুলো তীরবেগে ভিতরে অগ্রসর হয়। এদিকে তাদের পাশ কাটিয়ে অশ্বারোহী বাহিনীসহ আলেকজান্ডার পারস্যিক সৈন্যদলের কেন্দ্রস্থলে যেখানে সম্রাট দরিয়াবস দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। সঙ্গে সঙ্গে তার ফালাঙ্গোসও পারস্যিকদের আক্রমণ করে হটিয়ে দেয়। পরিস্থিতির আকষ্মিকতায় ভীতচকিত দরিয়াবস সর্বাগ্রে পালাতে শুরু করেন। তার পিছনে পিছনে তার সমগ্র বাহিনীও পালাতে শুরু করে। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পারস্য সাম্রাজ্যের পতন হল। এরফলে ২০০ বৎসরের (৫৩১-৩৩১ বিসিই) পারস্যিক শাসনেরও অবসান ঘটল।
পার্সিপলিস |
পারস্য সাম্রাজ্যের রাজধানী, পার্সিপলিস লুন্ঠিত ও ভষ্মিভূত হল গ্রীক সেনাদের হাতে। সমগ্র পারস্য অঞ্চল আলেকজান্ডারের দখলে চলে এল। কিন্তু এতেও তার বিজয়ের আকাঙ্খা পরিতৃপ্ত হয়নি। দূরপ্রাচ্যের দেশগুলির ধন-সম্পদ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। তিনি একবাটানা থেকে পূর্বদিকে অগ্রসর হতে শুরু করেন এবং মধ্য এশিয়া দখল শেষে ভারতীয় উপমহাদেশের দিকে এগিয়ে যান।
আলেকজান্ডার ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেন ৩২৭ বিসিই। হিন্দুকূশ পর্বত অতিক্রমের পর কাবুলের সন্নিকটে নিকাইয়া নামক স্থানে গ্রীক শিবির স্থাপিত হয়। তারপর সেখান থেকে তক্ষশীলা ও সিন্ধু উপত্যকার রাজন্যবর্গকে তার আনুগত্য স্বীকারের আমন্ত্রণ জানিয়ে দূত প্রেরিত হল।
আলেকজান্ডারের ভারতীয় উপমহাদেশে অভিযানের প্রাক্কালে সমগ্র ভারত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদ ও মহাজনপদে বিভক্ত ছিল। কেবলমাত্র ঝিলিম ও বিপাশা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলেই সাতটি ভিন্ন জাতির বসবাস ছিল এবং অঞ্চলটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। যেমন- অশ্বক রাজ্য (বুনার অঞ্চল), পুস্করাবতী (পেশোয়ার), তক্ষশীলা (রাওয়ালপিন্ডি), অভিসার, ঝিলিম ও চেনার নদীর মধ্যবর্তী পুরুর রাজ্য, গান্ধার, মালব ইত্যাদি অন্যতম। এইসব রাজ্যগুলো পরস্পর আত্মকলহ, যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকায় তাদের মধ্যে কোন ঐক্য ছিল না। প্রতিটি রাজ্য একারণে রাজনৈতিক ভাবে অস্থিতিশীল ছিল।
সর্বপ্রথম তক্ষশীলার রাজা অম্ভি আলেকজান্ডারের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। তিনি গ্রীক দূত তার নিকট পৌঁছানোর পূর্বেই বশ্যতা স্বীকারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচুর উপঢৌকনসহ আলেকজান্ডারের নিকট দূত প্রেরণ করেন। একে একে আলেকজান্ডার শশীগুপ্ত সঞ্জয়, কোফিউস আরও কতিপয় রাজন্যবর্গের বশ্যতা স্বীকারের প্রতিশ্রুতি পান।
কাবুলের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হলে আলেকজান্ডার (Alexander) সর্বপ্রথম পুস্করাবতীর রাজা অস্টক কর্তৃক বাঁধাপ্রাপ্ত হন। সম্মুখ সমরে পরাজিত হয়ে অস্টক দূর্গে আশ্রয় নেন। অতঃপর দীর্ঘ ৩০ দিন অবরুদ্ধের পর দূর্গের পতন হলে তিনি গ্রীক বাহিনীর হাতে নিহত হন।
পুস্করাবতীকে পদানত করে আলেকজান্ডার সম্মুখে অগ্রসর হন এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজন্যবর্গের প্রতিরোধ প্রতিহত করে সিন্ধুনদ অতিক্রম শেষে তক্ষশীলায় ছাউনি ফেলেন। এ সময় তক্ষশীলার রাজা অম্ভি স্থানীয় দলপতিদের সঙ্গে আলেকজান্ডারের পরিচয় করিয়ে দেন। এখানে অবস্থান কালেই অভিসার জাতির বশ্যতা স্বীকারপত্র দূতেরা আলেকজান্ডারের নিকট হস্তান্তর করেছিল।
তক্ষশীলা হতে পূর্বদিকে ঝিলাম নদী বরাবর অগ্রসর হন আলেকজান্ডার। ঝিলাম ও চন্দ্রভাগার মধ্যবর্তী অঞ্চলের রাজা ছিলেন পুরু। আলেকজান্ডার পুরুকে বশ্যতা স্বীকারের আমন্ত্রণ জানিয়ে দূত প্রেরণ করেন। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন পুরু তার এই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। বিনাযুদ্ধে এই রাজ্য দখল সম্ভব হবে না দেখে আলেকজান্ডার পুরুকে মিত্র সংগ্রহের কিম্বা যুদ্ধ প্রস্তুতির কোনরূপ অবকাশ না দিয়ে ৩২৬ বিসিইর মে মাসে ঝিলাম নদীর তীরে শিবির স্থাপন করেন। নিজ রাজ্যের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে নদীর অপর তীরে পুরু ছাউনি ফেলেন।
স্বল্প সময়ের মধ্যে পুরু গ্রীক বাহিনীর তুলনায় অধিক সেনাসমাবেশ করেছিলেন। সুতরাং আলেকজান্ডার কৌশলের আশ্রয় নেন, আর এমনিতেও তিনি সমর কুশলী ছিলেন। তিনি রাতের অন্ধকারে ঝিলাম নদীর গতিপথ ধরে ১৭ মাইল অগ্রসর হয়ে পিন্ডি খোয়াতে পৌঁছেন এবং নদী অতিক্রম করে প্রত্যুষে অতর্কিত পুরুর রাজ্যে প্রবেশ করেন।এতদ্রুত গ্রীক বাহিনী তার রাজ্যে প্রবেশ করতে পারে পুরু তার জন্যে আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। গ্রীক বাহিনীর ক্ষিপ্রতায় বিষ্মিত পুরু তার দুই পুত্রকে আলেকজান্ডারের গতিরোধ করতে প্রেরণ করেন। পুরুর পুত্রদ্বয়ের উভয়ই আলেকজান্ডারের সাথে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হয়।
পুত্রদের মৃত্যুতেও পুরু আত্মবিশ্বাস হারান না। তিনি ৫০ হাজার পদাতিক, চার হাজার অশ্বারোহী, তিন’শ রথ এবং দু‘শ হস্তি নিয়ে গ্রীক বাহিনীর মোকাবেলায় এগিয়ে যান এবং সুখচৈনপুর অতিক্রম করে প্রত্যুষে ঝিলাম নদীর তীরে আলেকজান্ডারের বার হাজার অশ্বারোহী ও তীরন্দাজ বাহিনীর মুখোমুখী হন।
পূর্বরাত্রির বৃষ্টিপাতে ঝিলাম নদী তীরের যুদ্ধক্ষেত্র পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত ছিল। যুদ্ধ শুরু হলে পুরু বাহিনীর অধিকাংশ রথের চাকাগুলো কাদায় আটকে গিয়ে সেগুলি একে একে অচল হয়ে পড়তে লাগল। আলেকজান্ডারের অশ্বারোহী বাহিনী এই সুযোগে দ্রুত বেগে পুরুর সেনাবাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে ছত্রভঙ্গ করে দিল। অসীম বীরত্বে যুদ্ধ করে পুরু আহত অবস্থায় বন্দী হন। এসময় তার শরীর নয়টি আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত ছিল।
পুরুকে খাঁচায় বন্দী করে আলেকজান্ডারের সম্মুখে উপস্থিত করা হলে পুরু তার প্রতি গ্রীক সম্রাটের এহেন ব্যবহারে তীব্র ক্ষোভ ও উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। এতে বিষ্মিত আলেকজান্ডার পুরুকে তার নিকট থেকে কিরূপ ব্যাবহার প্রত্যাশা করেন তা জিজ্ঞেস করেন। পুরু তার কাছে রাজকীয় সম্মান দাবী করে বসেন।
আলেকজান্ডার পুরুর অসাধারণ সাহস, বীরত্ব ও স্বদেশ প্রেমে মুগ্ধ হয়ে তার সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন এবং এই মিত্রতার নিদর্শণ স্বরূপ তার রাজ্য তাকে ফিরিয়ে দেন। আর পুরু আলেকজান্ডারের এই বিজয়ের নিদর্শণ স্বরূপ ঝিলাম নদীর তীরে বুকেফালা ও নিকাইয়া নামে দু‘টি নগরীর গোড়াপত্তন করেন।
আলেকজান্ডারের বিজয়াভিযানের রুট ম্যাপ। |
৩২৬ বিসিইর নভেম্বর মাসে আলেকজান্ডার ঝিলাম নদীর তীর ধরে অগ্রসর হলেন এবং ৩২৫ বিসিইর সেপ্টেম্বর মাসে বেলুচিস্থানের মধ্যে দিয়ে ব্যবিলনের পথে রওনা হন।
আলেকজান্ডার তার বিজিত অঞ্চল সমূহকে ৭টি প্রদেশে বিভক্ত করেছিলেন। এদের পাঁচটি ভারতীয় এবং অপর দু‘টি উপমহাদেশের বাইরে। ভারতীয় ৫টি প্রদেশের দু‘টিতে পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে তিনি গ্রীক গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন এবং অপর তিনটিতে ভারতীয় গভর্নর নিযুক্ত হযেছিল।
আলেকজান্ডার যখন পাঞ্জাবে অবস্থান করছিলেন, সেইসময় চন্দ্রগুপ্ত তার সাক্ষাৎপ্রার্থী হন। যে উদ্দেশ্যে চন্দ্রগুপ্তের এই মিশন তা হল মগধরাজ ধননন্দকে সিংহাসনচ্যূত করতে আলেকজান্ডারের সহায়তা লাভ। সুতরাং চন্দ্রগুপ্ত ধননন্দের প্রতি প্রজাসাধারণের ঘৃণা ও বীতশ্রদ্ধার কথা আলেকজান্ডারের কাছে তুলে ধরেন এবং সাথে সাথে প্রজাসাধারণের পক্ষ থেকে ধননন্দকে উৎখাতে সাহায্য সহযোগীতার প্রতিশ্রুতিও দেন।
চন্দ্রগুপ্তের এই মিশন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল। গ্রীক সহায়তা লাভের বদলে নিজের মৃত্যুদন্ডাদেশ কাঁধে নিয়ে তিনি পলায়ন করে কোনরকমে নিজ প্রাণ রক্ষা করেন। চন্দ্রগুপ্ত তার নির্ভিক ও তেজোদীপ্ত আচরণের জন্যে আলেকজান্ডার কর্তৃক মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
চন্দ্রগুপ্ত ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত ছিলেন। কোন এক যুদ্ধে তার পিতা মারা গেলে তার মাতা মূরা দেবী বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এবং অন্ত:সত্ত্বা অবস্থায় মগধের রাজধানী পাটালীপুত্রে আশ্রয় গ্রহণ করেন। চন্দ্রগুপ্ত সেখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মূরাদেবীর আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায় এক রাখাল চন্দ্রগুপ্তকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করে। চন্দ্রগুপ্ত এই রাখালের গৃহে কিছুদিন লালিত-পালিত হন। অত:পর বালক চন্দ্রগুপ্তের রাজসদৃশ চেহারা ও বুদ্ধিমত্তা লক্ষ্য করে তাকে তক্ষশীলার এক ব্রাহ্মণ চানক্য যিনি বিষ্ণুগুপ্ত ও কৌটিল্য নামেও পরিচিত, সঙ্গে করে নিয়ে যান এবং তাকে রাজনীতি ও সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে থাকেন। এর কারণ ছিল এই যে, এই কৌটিল্য প্রকাশ্য রাজদরবারে একবার নন্দরাজ কর্তৃক অপমানিত হয়েছিলেন।
ধননন্দের পিতৃশ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার জন্যে একজন ব্রাহ্মণের প্রয়োজন হয়। তখন মন্ত্রী শকটার কৌটিল্য বা চাণক্যকে ঐ শ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার জন্যে আমন্ত্রণ জানান। তারপর যখন কৌটিল্য রাজপ্রসাদে উপস্থিত হয়ে প্রধান পুরোহিতের আসন গ্রহন করেন, তখন কুৎসিৎ কদাকার চেহারার কৌটিল্যকে দেখে ধনানন্দ ভীষণ ক্রুদ্ধ হন। তিনি তাকে টিকি ধরে তার আসন থেকে টেনে তুলে ঘেটি ধরে রাজপ্রাসাদ থেকে বের করে দেন। আর কৌটিল্য এই অপমানের প্রতিশোধ নেবার প্রতিজ্ঞা করেন এবং ব্রত পালন করতে থাকেন।
চন্দ্রগুপ্ত আলেকজান্ডারের সাহায্য লাভে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে সেনাবাহিনী সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন এবং কূটবুদ্ধি সম্পন্ন ব্রাহ্মণ চানক্যের সহযোগীতায় পার্শ্ববর্তী প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যগুলো থেকে সেনা সংগ্রহ করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিন্ধ্যা পর্বতে একদক্ষ সেনাদল গড়ে তোলেন। এই সেনাবাহিনী শক, যবন, কিরাত, কম্বোজ প্রভৃতি জাতির যোদ্ধা দ্বারা গঠিত হয়েছিল।
ধননন্দের পিতৃশ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার জন্যে একজন ব্রাহ্মণের প্রয়োজন হয়। তখন মন্ত্রী শকটার কৌটিল্য বা চাণক্যকে ঐ শ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার জন্যে আমন্ত্রণ জানান। তারপর যখন কৌটিল্য রাজপ্রসাদে উপস্থিত হয়ে প্রধান পুরোহিতের আসন গ্রহন করেন, তখন কুৎসিৎ কদাকার চেহারার কৌটিল্যকে দেখে ধনানন্দ ভীষণ ক্রুদ্ধ হন। তিনি তাকে টিকি ধরে তার আসন থেকে টেনে তুলে ঘেটি ধরে রাজপ্রাসাদ থেকে বের করে দেন। আর কৌটিল্য এই অপমানের প্রতিশোধ নেবার প্রতিজ্ঞা করেন এবং ব্রত পালন করতে থাকেন।
চন্দ্রগুপ্ত আলেকজান্ডারের সাহায্য লাভে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে সেনাবাহিনী সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন এবং কূটবুদ্ধি সম্পন্ন ব্রাহ্মণ চানক্যের সহযোগীতায় পার্শ্ববর্তী প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যগুলো থেকে সেনা সংগ্রহ করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিন্ধ্যা পর্বতে একদক্ষ সেনাদল গড়ে তোলেন। এই সেনাবাহিনী শক, যবন, কিরাত, কম্বোজ প্রভৃতি জাতির যোদ্ধা দ্বারা গঠিত হয়েছিল।
৩২৪ বিসিই চন্দ্রগুপ্ত তার সেনাবাহিনী নিয়ে মগধ আক্রমণ করেন। এই সংঘর্ষে নন্দরাজ পরাজিত ও নিহত হলে চন্দ্রগুপ্ত মগধের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন এবং কৌটিল্য হন তার উপদেষ্টা।
আলেকজান্ডার তার বাহ্যিক সাফল্যগুলির দ্বারা বিমোহিত হয়ে, তার আদর্শ সমূহকে বিসর্জন দিয়েছিলেন। এরূপে পূর্বাঞ্চলে তার শেষ বৎসরগুলিতে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পূর্ণরূপে পাল্টে গিয়েছিল। তিনি তার চারপাশের বিভিন্ন প্রলোভন দ্বারা দারুনভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানে আসক্ত এবং এক ধরণের জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই জ্বরই তার মৃত্যুর কারণ হল।
বাবিলে ৩২৩ বিসিই বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার মৃত্যুবরণ করেন। এসময় তার বয়স ছিল মাত্র ৩৩ বৎসর। এত অল্প বয়সী হলেও ইতিমধ্যেই তিনি এক যুগান্তকারী ইতিহাস সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন।
আলেকজান্ডার যখন মৃত্যুবরণ করেছিলেন তখন তার উত্তরাধিকারী হওয়ার মত এমন কোন শক্তিশালী লোক ছিলেন না যিনি তার বিজিত বিশাল সাম্রাজ্য একত্রে ধরে রাখতে পারেন। তার মৃত্যুরপর তাকে সমাধিস্থ করার পূর্বেই তার সেনাপতিদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়ে যায়। তার এই সাম্রাজ্য অত:পর তার চারজন সেনাপতির মধ্যে ভাগ হয়ে গেল। এই সেনাপতিরা হলেন টলেমি, লাইসিয়াস, কাসেন্ডার এবং সেলুকাস। আর এই বিভাগগুলি ছিল পশ্চিমাঞ্চল অথবা গ্রীস, উত্তরাঞ্চল অথবা আর্মেনিয়া, পূর্বাঞ্চল অথবা সিরিয়া এবং দক্ষিণাঞ্চল বা মিসর। সেলুকাসের শাসনাধীনে সিরিয়া বা পূর্বাঞ্চলের অংশে পড়েছিল পাঞ্জাব, সিন্ধু, পারস্য ও প্যালেষ্টাইনের উত্তরাঞ্চল। টলেমীর শাসনাধীন দক্ষিণাঞ্চল বা মিসরীয় ভাগের অন্তর্ভূক্ত ছিল প্যালেস্টাইনের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল। বস্তুতঃ প্যালেস্টাইন সেলুকাস এবং টলেমি এই দু’শক্তির মাঝে পড়েছিল।
আলেকজান্ডারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার শোভাযাত্রা। |
সেলুকাস তার রাজ্যে গ্রীসের অনুরূপ নগর রাষ্ট্র গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছিলেন যার অন্যতম ছিল দজলা বা টাইগ্রিসে অবস্থিত সেলেওসিয়া। এখানে তিনি পশ্চিমা দেবদেবীদের মূর্ত্তি স্থাপন করেছিলেন এবং পশ্চিমা শিল্পকলা ও চিন্তাধারার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই চন্দ্রগুপ্ত গ্রীক শাসকদের বিতাড়নের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। প্রথমে নন্দ বংশের উচ্ছেদ সাধন করে তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তার রাজ্য বিস্তার অব্যহত রাখেন। একই সঙ্গে একের পর এক গ্রীক অধিকৃত অঞ্চলসমূহ জয় করে পাঞ্জাবের নিকটবর্তী হন। আলেকজান্ডারের নিয়োজিত গ্রীক শাসনকর্তা সেলিওকাস তাকে দমন ও বিজিত রাজ্যসমূহ পুন:রুদ্ধার করতে ৩০৫ বিসিই সিন্ধুতে এসে পৌছিলে চন্দ্রগুপ্ত কর্তৃক প্রচন্ড বাঁধার সম্মুখীন হন। এতে সেলিওকাস চন্দ্রগুপ্তের সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন। সন্ধির আশু শর্তানুসারে সেলিওকাস চন্দ্রগুপ্তকে কাবুল, কান্দাহার, হিরাট ও মাকরান প্রদেশ ছেড়ে তো দিলেনই উপরন্তু নিজকন্যা হেলেনের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের বিবাহ দিয়েছিলেন। অন্যদিকে বন্ধুত্বের নিদর্শণ স্বরূপ চন্দ্রগুপ্ত সেলিওকাসকে পাঁচশত হাতি উপহার দেন। দীর্ঘ ২৪ বৎসর রাজত্বের পর ৩০০ বিসিই এই চন্দ্রগুপ্ত অবশেষে মহীশুরের শ্রাবণ বেলগোলা নামক স্থানে অনশনে মৃত্যুবরণ করেন।
No comments:
Post a Comment