Human Timelines Myth & History

Hot

Post Top Ad

Post Top Ad

Saturday, February 17, 2018

দিগবিজয়ী মহান সম্রাট আলেকজান্ডার

February 17, 2018 0
৩৩৫-৩৩৪ বিসিই গ্রীসের সিংহাসনে বসলেন আলেকজান্ডার। তার পিতা ছিলেন ২য় ফিলিপ, যিনি ৩৩৪ বিসিই তার মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত মেসিডোনিয়ার রাজা ছিলেন। এই মেসিডোনিয়া গ্রীসের অন্যতম প্রধান রাজ্য ছিল। আর এসময় এখানে সকল প্রকার শিল্পকলার বিকাশ ঘটেছিল এবং উৎকর্ষতা শিখরে পৌঁছেছিল। দর্শন, সাহিত্য, ভাস্কর্য, স্থাপত্য-শিল্প এবং অন্যান্য কলায় তারা সমসাময়িক অন্যান্য জাতিসমূহের তুলনায় শ্রেষ্টত্ব অর্জন করেছিল। এখানেই থুসিডাইডেস, অ্যারিষ্টফেনিস, জেনোফোন, সক্রেটিস, প্লেটো, এরিষ্টোটল, ডায়োজিনিস, ডিমোস্থিনিস এবং আরও অনেক মহৎ মহৎ লোকের জন্ম হয়েছিল। বিশ্ব বিজয়ী আলেকজান্ডার এরিষ্টোটলের ছাত্র ছিলেন। 

আলেকজান্ডারকে পাঠদানরত এরিস্টোটল
গ্রীসের সভ্যতা ছিল মূলতঃ নগর কেন্দ্রিক। এটি নগরসমূহে বিকাশ লাভ করেছিল এবং নগরবাসীদের দ্বারা বিস্তার লাভ করেছিল। প্রাচ্যের নগরগুলি কিছু সংখ্যক দালান-কোঠা নিয়ে গড়ে উঠেছিল। জনগণের মধ্যে কোন সুষ্ঠ পরিকল্পণা ছিল না। একজন স্বৈরাচারী শাসকের দ্বারা সেগুলি শাসিত হত। তাই জনগণের অবস্থা ছিল প্রায় ক্রীতদাস পর্যায়ের। অপরদিকে গ্রীসের নগরগুলি ছিল সুপরিকল্পিত এবং শিল্পমন্ডিতভাবে নির্মিত। জনগণ কর্মাধ্যক্ষগণকে নির্বাচিত করত, জনগণের বিষয়সমূহ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করত এবং তাদের সরকারী ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করত। গ্রীকেরা মনে করত যে জীবন উত্তম এবং তা উপভোগ করা উচিৎ। স্বাস্থ্য ছিল সুখের ভিত্তি। ব্যায়ামাগার ছিল একটি জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। এখানে খেলাধূলা, ক্রীড়া প্রতিযোগীতা, নৃত্য, গান-বাজনা, কাব্যচর্চা ইত্যাদি গুরুত্বসহকারে অনুশীলন করা হত। তাদের ক্রীড়া প্রতিযোগীতার জন্যে ছিল স্টেডিয়াম, রথ চালানোর জন্যে ছিল বড় মাঠ, নাট্যানুষ্ঠানের জন্যে ছিল থিয়েটার।

সাহিত্য ও শিল্পকলা গ্রীকদের জীবনে একটি বিরাট স্থান দখল করেছিল। বুদ্ধিগত বিকাশ সম্পর্কে সতর্ক ছিল বিধায়, তারা বিভিন্ন শিক্ষালয় স্থাপন করেছিল। তারা দর্শণশাস্ত্র নিয়ে আলাপ আলোচনা করত। শিল্পকলা এবং ভাস্কর্য শিক্ষার্থীদের জন্যে তাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। তাদের প্রত্যেকটি দালান কোঠায় আবশ্যিকভাবে কারুকার্য করা হত। এই কারুকার্য বা ভাস্কর্য প্রধানতঃ ছিল তাদের বিভিন্ন দেবদেবীদের নিয়ে। তাদের কাছে শিল্পকলাবিহীন একটি নগরী ছিল অচিন্ত্যনীয়। তারা তাদের ভাষাকে ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষায় পরিণত করেছিল।

প্রাচ্যের অন্যান্য জাতিসমূহ থেকে গ্রীকদের জীবন-যাপনের পদ্ধতি ও রীতিনীতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের। তাদের পোশাক ছিল জমকাল, ঢিলে-ঢালা এবং তারা চওড়া কান বিশিষ্ট টুপি মাথায় দিত। তাদের জীবন দর্শন ছিল এই ধরণের যে, জীবনকে আজই উপভোগ করতে হবে, আগামীকাল আমরা নাও থাকতে পারি। এই কারণে গ্রীকেরা ভোগ-বিলাসকে তাদের অন্যতম প্রধান বিষয় মনে করত। তদের কাছে ধর্ম ছিল ভবিষ্যৎ জীবনের বিষয় তাই তাদের চিন্তা-ভাবনায় এর স্থান ছিল সামান্য মাত্র।

আলেকজান্ডারের মূর্ত্তি, 
ইস্তাম্বুল।
গ্রীসের উত্তর-পূর্ব দিকে বলকান উপদ্বীপে অবস্থিত ছিল মেসিডোনিয়া। এখানকার অধিকাংশ জনগণ ছিল কৃষিজীবি। বিসিই ৪র্থ শতকের মধ্যভাগে রাজা ২য় ফিলিপমেসিডোনিয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং এক শক্তিশালী সেনাদল গঠন করলেন। কৃষকদের মধ্যে থেকে বেঁছে বেঁছে তিনি তার পদাতিক বাহিনী গঠন করেছিলেন। যুদ্ধে পদাতিকদের নিয়েই ফালাঙ্গোস তৈরী করা হত। অভিজাত মেসিডোনিয়রা হত অশ্বারোহী যোদ্ধা।

রাজা ২য় ফিলিপ তার শক্তিশালী সেনাবাহিনী দ্বারা একের পর এক গ্রীক শহর দখল করতে শুরু করলেন। গ্রীক দাস মালিকদের একাংশ স্বেচ্ছায় তার বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। জন্মভূমির স্বাধীনতার চেয়ে তারা বেশী মূল্য দিত নিজেদের ধন-সম্পত্তিকে। এমনও ঘটেছে যে, রাজা ফিলিপ কাউকে কিছু উৎকোচ দিয়েছেন, আর তারা পরে দূর্গের প্রবেশদ্বার তার জন্যে খুলে দিচ্ছে। এ করণে ফিলিপ ব্যঙ্গ করে বলতেন যে-‘সোনাভরা গর্দভ যে কোন শহর নিয়ে নিতে পারে।’

মেসিডোনিয় সম্রাটের বিরুদ্ধে এথেনিয় দেমোস উঠে দাঁড়িয়েছিল। আত্তিকা প্রদেশের শাসক অভিজাতবর্গ ব্যতিরেকে সমস্ত স্বাধীন এথেন্সবাসীদের বলা হয় দেমোস। এদের বেশিরভাগই ছিল কৃষক, কারিগর, মাঝিমাল্লা ও দিনমুজুর। যাহোক বিখ্যাত বাগ্মী ডিমোস্থিনিস তার জ্বালাময়ী বক্তৃতায় ২য় ফিলিপকে পরস্বাপহারী রূপে সকলের সম্মুখে প্রকাশ করেন এবং গ্রীকদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে আহবান জানান। এরফলে মধ্যগ্রীসের নগর রাষ্ট্রসমূহের একাংশ মেসিডোনিয়ার সাথে সংগ্রামের জন্যে ঐক্যবদ্ধ হয়। 

মেসিডোনিয়া।
৩৩৮ বিসিই খেরোনিয়া শহরের নিকটে এথেনিয় ও মেসিডোনিয়দের চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয়। এথেনিয়দের সাথে এক সাঁরিতে দাঁড়িয়ে সাধারণ যোদ্ধার ন্যায় যুদ্ধ করেছিলেন ডিমোস্থিনিস। 

এথেনিয় সেনাবাহিনী কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে গড়ে উঠেছিল। সেনাবাহিনীতে ভর্ত্তির সময় তরুণেরা শপথ নিত। তাদের শপথ ছিল এমন- ‘আমি এই পবিত্র অস্ত্রের অসম্মান করব না এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেখানেই থাকি, কখনই আমার সঙ্গীকে পরিত্যাগ করব না। আমি আমার পর্ণ কুঠির রক্ষার জন্যে যুদ্ধ করব এবং তারপরে পিতৃভূমিকে দূর্বল তো করবই না, বরং আরও পরাক্রান্ত ও শক্তিশালী করে তুলব। আমি নিজে অন্যদের সাথে বর্তমানে প্রচলিত আইন-কানুন এবং ভবিষ্যতে যেসব আইন-কানুন প্রবর্তিত হবে, সেসবও মেনে চলব। স্বদেশের সমুদয় পবিত্র বস্তুকে আমি ভক্তি করব। দেবতারা আমার সাক্ষী-সাক্ষী স্বদেশের সীমানা, গম ও যবের শস্য ক্ষেত, জলপাইয়ের বাগান ও দ্রাক্ষাক্ষেত।’

এথেনীয়দের দৃঢ় মনোবল ও নেতৃত্বের কারণে দীর্ঘদিন ধরে এই ভয়াবহ যুদ্ধ চলে। প্রথম দিকে ২য় ফিলিপের বাহিনীকে এথেনিয়রা পিছু হটিয়ে দেয়। অবশ্য উন্নততর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জ্বিত এবং অধিক নিয়ম শৃঙ্খলায় অভ্যস্ত মেসিডোনিয় সেনাবাহিনী জয়লাভ করেছিল। এই জয়লাভের ফলে প্রায় সমস্ত গ্রীস মেসিডোনিয়ার পদানত হয়। 

আলেকজান্ডার বাল্যকাল থেকেই ইচ্ছে পোষণ করতেন যে, তিনি সিংহাসনে আরোহণের পর বিশ্ব জয়ের মত বিশাল এবং গৌরবময় কোন কার্য্য করবেন। গোর্দিউস নগরে একটি রথের উপরে ‘গোর্দিউস গিঁট’ অত্যন্ত জটিলভাবে জঁটপাকানো একটি গিঁট রাখা ছিল। কথিত ছিল যে, যিনি ঐ গিঁট খুলতে পারবেন তিনি সমগ্র এশিয়ার অধিপতি হবেন। অনেকেই গিঁট খুলতে চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু কেউই তা খুলতে পারেনি। আলেকজান্ডারও চেষ্টা করেন। অত:পর যখন ব্যর্থ হলেন, তখন তিনি তরবারী দ্বারা গিঁটটা কেটে ফেললেন। এ থেকেই এ বাগিধির উৎপত্তি: To cut the Gordian knot. অর্থাৎ জটিল ও গোলমেলে কোন সমস্যার দ্রুত চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা। 

সুতরাং পিতা ২য় ফিলিপের এই বিজয়াভিযানের সাফল্য শুনে যুবক আলেকজান্ডার তাই বলেছিলেন, ‘আমার পিতাই সব অধিকার করে নেবেন দেখছি, বিরাট ও গৌরবময় কোন কিছু করার সুযোগ আর আমার কপালে বোধহয় নেই।’ 
Plutarch stated, Philip overjoyed at his courage and ambition, kissed his son and declared: "My boy, you must find a kingdom big enough for your ambitions. Macedon is too small for you",

সমস্ত গ্রীস নিজের অধিকারে নিয়ে আসার পর রাজা ২য় ফিলিপ পারস্য অভিযানের জন্যে তৈরী হতে লাগলেন। এই অভিযান প্রস্তুতি কালে চক্রান্তকারীদের হাতে নিহত হলেন তিনি। তখন তার ২০ বৎসর বয়স্ক পুত্র আলেকজান্ডার সিংহাসনে উপবেশন করলেন।

আলেকজান্ডার সিংহাসনে আরোহণের অল্পদিনের মধ্যে ৩০ হাজার পদাতিক ও পাঁচ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে বের হন দিগিজয়ে এবং অল্পদিনেই লক্ষ লক্ষ মানুষের এবং বহু জাতির ভাগ্যনিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। তিনি তার সংক্ষিপ্ত বার বৎসরের রাজত্বকালে যে বিশাল বিজয় অর্জন করেন তার পূর্বে অন্য কেউ সেরূপ করতে সক্ষম হননি।

ইসসুজের যুদ্ধ।
বিশ্বজয়ের প্রথমদিকে পারস্য সাম্রাজ্যের এশিয়া মাইনরে প্রবেশ করে আলেকজান্ডার ৩য় দরিয়াবসের পারস্যিক সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করেন এবং ইসসুজের যুদ্ধে তাদের পরাজিত করেন। তারপর তার বাহিনী ভূ-মধ্য সাগরের তীর ধরে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যায়। আলেকজান্ডারের পদানত হয় উত্তর সিরিয়াসহ ফ্রিজিয়া, কেপডাসিয়া এবং সেলেওসিয়া। তারপর তিনি সিরিয়া এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে দিয়ে মিসরের দিকে অগ্রসর হয়ে সোর নগরী অবরোধ করেন। পতনের পূর্বে সোর কয়েক মাস গ্রীক সেনাবাহিনীকে ঠেকিয়ে রেখেছিল।

যুদ্ধে সোরীয়রা পরাজিত হল। আলেকজান্ডার ছিলেন বদরাগী ও নিষ্ঠুর। তার বিরুদ্ধে যারা রূখে দাঁড়িয়েছে সেইসব জনগোষ্ঠীকে তিনি নির্মমভাবে হত্যা করেছেন নয়ত: তাদের দাসে পরিণত করেছেন। সোর নগরী আত্মসমর্পণে অস্বীকৃত হওয়ায় আলেকজান্ডার পুরো নগরী পুড়িয়ে ছারখার করে দেন। অত:পর নগরী দখল করার পর তার ৮ হাজার অধিবাসীকে হত্যা ও ৩০ হাজার অধিবাসীকে বন্দী করে বাজারে দাসরূপে বিক্রি করে দেন।

আলেকজান্দ্রিয়া নগরীর পত্তন।
পুনঃরায় মিসরের পথে আলেকজান্ডার জেরুজালেমে প্রবেশ করেন এবং বিনা বাঁধায় তা দখল করে নেন। জেরুজালেমের বাইরে সেইসময় একদল ধর্মীয়নেতা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এদের মধ্যে এমন একজন ছিলেন, যিনি পূর্বেই তার সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে, তিনি বিশ্বজয় করবেন। আলেকজান্ডার তাদের দ্বারা প্রভাবিত হন এবং পবিত্র নগরী সম্পর্কীত যুক্তিসঙ্গত শর্তাবলী মঞ্জুর করেন। 

জেরুজালেম থেকে আলেকজান্ডার তার সেনাবাহিনী নিয়ে মিসর অভিমুখী হন এবং শীঘ্রই তা তার করতলগত হয়। এই প্রাচীন দেশের উত্তর সমুদ্রতীরে তিনি এক মহানগরী স্থাপন করেন এবং তার নাম দেন আলেকজান্দ্রিয়া। এতেও তিনি সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি তার সেনাবাহিনী নিয়ে অশুর দেশের মরুভূমি, অরবিলায় দরিয়াবসের সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করার জন্যে প্যালেস্টাইন এবং সিরিয়ার মধ্যে দিয়ে আবার ফিরে আসেন। 

 ফালাঙ্গোস।
আলেকজান্ডার তার সেনাবাহিনী নিয়ে মেসোপটেমিয়ায় এসে পৌঁছেন। পারস্য সম্রাট ৩য় দরিয়াবস বিশাল সৈন্য সমাবেশ করেছিলেন। তার বাহিনীতে রণহস্তী ও রথ ছিল। রথের সাথে কাস্তে জাতীয় ধারাল অস্ত্র বাঁধবার ব্যবস্থা ছিল, যাতে করে যুদ্ধের সময় বিপক্ষেরা তার আঘাতে ধরাশায়ী হয়। ৩৩১ বিসিই টাইগ্রিস নদীর ধারে গিউগামেলা নামক এক বসতির নিকটবর্তী বিস্তীর্ণ প্রান্তর, অরবিলায় আলেকজান্ডার দরিয়াবসের সেনাবাহিনীর মুখোমুখী হন। শুরু হল বিখ্যাত গ্রানিকাসের যুদ্ধ। 

যুদ্ধের শুরুতে দারিয়াবস আক্রমণের জন্যে রথীদের পাঠালে গ্রীক বাহিনী শর নিক্ষেপ করে তাদের অধিকাংশকে নিহত করে ফেলে এবং নিজেরা দু‘পাশে সরে যাওয়া মাত্র পারস্যিকদের ক্ষিপ্তপ্রায় ধাবমান যুদ্ধাশ্বগুলো তীরবেগে ভিতরে অগ্রসর হয়। এদিকে তাদের পাশ কাটিয়ে অশ্বারোহী বাহিনীসহ আলেকজান্ডার পারস্যিক সৈন্যদলের কেন্দ্রস্থলে যেখানে সম্রাট দরিয়াবস দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। সঙ্গে সঙ্গে তার ফালাঙ্গোসও পারস্যিকদের আক্রমণ করে হটিয়ে দেয়। পরিস্থিতির আকষ্মিকতায় ভীতচকিত দরিয়াবস সর্বাগ্রে পালাতে শুরু করেন। তার পিছনে পিছনে তার সমগ্র বাহিনীও পালাতে শুরু করে। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পারস্য সাম্রাজ্যের পতন হল। এরফলে ২০০ বৎসরের (৫৩১-৩৩১ বিসিই) পারস্যিক শাসনেরও অবসান ঘটল।

পার্সিপলিস
সম্রাট ৩য় দরিয়াবস পালিয়ে যান এশিয়ার দিকে। পরে নিহত হন মধ্য এশিয়ার ব্যাকটেরিয়ায়।আলেকজান্ডার ব্যাবিলন হয়ে পৌঁছে যান পার্সিপলিস।

পারস্য সাম্রাজ্যের রাজধানী, পার্সিপলিস লুন্ঠিত ও ভষ্মিভূত হল গ্রীক সেনাদের হাতে। সমগ্র পারস্য অঞ্চল আলেকজান্ডারের দখলে চলে এল। কিন্তু এতেও তার বিজয়ের আকাঙ্খা পরিতৃপ্ত হয়নি। দূরপ্রাচ্যের দেশগুলির ধন-সম্পদ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। তিনি একবাটানা থেকে পূর্বদিকে অগ্রসর হতে শুরু করেন এবং মধ্য এশিয়া দখল শেষে ভারতীয় উপমহাদেশের দিকে এগিয়ে যান। 

আলেকজান্ডার ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেন ৩২৭ বিসি। হিন্দুকূশ পর্বত অতিক্রমের পর কাবুলের সন্নিকটে নিকাইয়া নামক স্থানে গ্রীক শিবির স্থাপিত হয়। তারপর  সেখান থেকে তক্ষশীলা ও সিন্ধু উপত্যকার রাজন্যবর্গকে তার আনুগত্য স্বীকারের আমন্ত্রণ জানিয়ে দূত প্রেরিত হল। 

আলেকজান্ডারের ভারতীয় উপমহাদেশে অভিযানের প্রাক্কালে সমগ্র ভারত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদ ও মহাজনপদে বিভক্ত ছিল। কেবলমাত্র ঝিলিম ও বিপাশা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলেই সাতটি ভিন্ন জাতির বসবাস ছিল এবং অঞ্চলটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। যেমন- অশ্বক রাজ্য (বুনার অঞ্চল), পুস্করাবতী (পেশোয়ার), তক্ষশীলা (রাওয়ালপিন্ডি), অভিসার, ঝিলিম ও চেনার নদীর মধ্যবর্তী পুরুর রাজ্য, গান্ধার, মালব ইত্যাদি অন্যতম। এইসব রাজ্যগুলো পরস্পর আত্মকলহ, যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকায় তাদের মধ্যে কোন ঐক্য ছিল না। প্রতিটি রাজ্য একারণে রাজনৈতিক ভাবে অস্থিতিশীল ছিল।

সর্বপ্রথম তক্ষশীলার রাজা অম্ভি আলেকজান্ডারের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। তিনি গ্রীক দূত তার নিকট পৌঁছানোর পূর্বেই বশ্যতা স্বীকারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচুর উপঢৌকনসহ আলেকজান্ডারের নিকট দূত প্রেরণ করেন। একে একে আলেকজান্ডার শশীগুপ্ত সঞ্জয়, কোফিউস আরও কতিপয় রাজন্যবর্গের বশ্যতা স্বীকারের প্রতিশ্রুতি পান।

কাবুলের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হলে আলেকজান্ডার (Alexander) সর্বপ্রথম পুস্করাবতীর রাজা অস্টক কর্তৃক বাঁধাপ্রাপ্ত হন। সম্মুখ সমরে পরাজিত হয়ে অস্টক দূর্গে আশ্রয় নেন। অতঃপর দীর্ঘ ৩০ দিন অবরুদ্ধের পর দূর্গের পতন হলে তিনি গ্রীক বাহিনীর হাতে নিহত হন।

পুস্করাবতীকে পদানত করে আলেকজান্ডার সম্মুখে অগ্রসর হন এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজন্যবর্গের প্রতিরোধ প্রতিহত করে সিন্ধুনদ অতিক্রম শেষে তক্ষশীলায় ছাউনি ফেলেন। এ সময় তক্ষশীলার রাজা অম্ভি স্থানীয় দলপতিদের সঙ্গে আলেকজান্ডারের পরিচয় করিয়ে দেন। এখানে অবস্থান কালেই অভিসার জাতির বশ্যতা স্বীকারপত্র দূতেরা আলেকজান্ডারের নিকট হস্তান্তর করেছিল।

তক্ষশীলা হতে পূর্বদিকে ঝিলাম নদী বরাবর অগ্রসর হন আলেকজান্ডার। ঝিলাম ও চন্দ্রভাগার মধ্যবর্তী অঞ্চলের রাজা ছিলেন পুরু। আলেকজান্ডার পুরুকে বশ্যতা স্বীকারের আমন্ত্রণ জানিয়ে দূত প্রেরণ করেন। আত্মমর্যাদা সম্পন্ন পুরু তার এই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। বিনাযুদ্ধে এই রাজ্য দখল সম্ভব হবে না দেখে আলেকজান্ডার পুরুকে মিত্র সংগ্রহের কিম্বা যুদ্ধ প্রস্তুতির কোনরূপ অবকাশ না দিয়ে ৩২৬ বিসিইর মে মাসে ঝিলাম নদীর তীরে শিবির স্থাপন করেন। নিজ রাজ্যের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে নদীর অপর তীরে পুরু ছাউনি ফেলেন।

স্বল্প সময়ের মধ্যে পুরু গ্রীক বাহিনীর তুলনায় অধিক সেনাসমাবেশ করেছিলেন। সুতরাং আলেকজান্ডার কৌশলের আশ্রয় নেন, আর এমনিতেও তিনি সমর কুশলী ছিলেন। তিনি রাতের অন্ধকারে ঝিলাম নদীর গতিপথ ধরে ১৭ মাইল অগ্রসর হয়ে পিন্ডি খোয়াতে পৌঁছেন এবং নদী অতিক্রম করে প্রত্যুষে অতর্কিত পুরুর রাজ্যে প্রবেশ করেন।এতদ্রুত গ্রীক বাহিনী তার রাজ্যে প্রবেশ করতে পারে পুরু তার জন্যে আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। গ্রীক বাহিনীর ক্ষিপ্রতায় বিষ্মিত পুরু তার দুই পুত্রকে আলেকজান্ডারের গতিরোধ করতে প্রেরণ করেন। পুরুর পুত্রদ্বয়ের উভয়ই আলেকজান্ডারের সাথে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হয়।

পুত্রদের মৃত্যুতেও পুরু আত্মবিশ্বাস হারান না। তিনি ৫০ হাজার পদাতিক, চার হাজার অশ্বারোহী, তিন’শ রথ এবং দু‘শ হস্তি নিয়ে গ্রীক বাহিনীর মোকাবেলায় এগিয়ে যান এবং সুখচৈনপুর অতিক্রম করে প্রত্যুষে ঝিলাম নদীর তীরে আলেকজান্ডারের বার হাজার অশ্বারোহী ও তীরন্দাজ বাহিনীর মুখোমুখী হন। 

পূর্বরাত্রির বৃষ্টিপাতে ঝিলাম নদী তীরের যুদ্ধক্ষেত্র পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত ছিল। যুদ্ধ শুরু হলে পুরু বাহিনীর অধিকাংশ রথের চাকাগুলো কাদায় আটকে গিয়ে সেগুলি একে একে অচল হয়ে পড়তে লাগল। আলেকজান্ডারের অশ্বারোহী বাহিনী এই সুযোগে দ্রুত বেগে পুরুর সেনাবাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে ছত্রভঙ্গ করে দিল। অসীম বীরত্বে যুদ্ধ করে পুরু আহত অবস্থায় বন্দী হন। এসময় তার শরীর নয়টি আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত ছিল। 

পুরুকে খাঁচায় বন্দী করে আলেকজান্ডারের সম্মুখে উপস্থিত করা হলে পুরু তার প্রতি গ্রীক সম্রাটের এহেন ব্যবহারে তীব্র ক্ষোভ ও উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। এতে বিষ্মিত আলেকজান্ডার পুরুকে তার নিকট থেকে কিরূপ ব্যাবহার প্রত্যাশা করেন তা জিজ্ঞেস করেন। পুরু তার কাছে রাজকীয় সম্মান দাবী করে বসেন।

আলেকজান্ডার পুরুর অসাধারণ সাহস, বীরত্ব ও স্বদেশ প্রেমে মুগ্ধ হয়ে তার সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন এবং এই মিত্রতার নিদর্শণ স্বরূপ তার রাজ্য তাকে ফিরিয়ে দেন। আর পুরু আলেকজান্ডারের এই বিজয়ের নিদর্শণ স্বরূপ ঝিলাম নদীর তীরে বুকেফালা ও নিকাইয়া নামে দু‘টি নগরীর গোড়াপত্তন করেন।

আলেকজান্ডারের বিজয়াভিযানের রুট ম্যাপ।
অপরাজিত গ্রীক বাহিনীর হাতে পুরুর পরাজয়ের পর রাভী নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সমূহের প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যগুলো আলেকজান্ডারের আনুগত্য স্বীকার করে নিল। সুতরাং ছোট খাট আর কোন বাঁধা বিপত্তি না থাকায় আলেকজান্ডার সরাসরি মগধ আক্রমণের মানসে সসৈন্যে বিপাশা নদীর তীরে এসে ছাউনি ফেলেন। এসময় নদীর ওপারে মগধের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন ধননন্দ। এখানেই আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনীর মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিল। সেনাবাহিনী দীর্ঘসময় যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় অত্যাধিক রণক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই তারা আর অধিক দূর অগ্রসর হতে অনীহা প্রকাশ করে দেশে ফেরার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সুতরাং আলেকজান্ডার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করা স্থির করেন।

৩২৬ বিসিইর নভেম্বর মাসে আলেকজান্ডার ঝিলাম নদীর তীর ধরে অগ্রসর হলেন এবং ৩২৫ বিসিইর সেপ্টেম্বর মাসে বেলুচিস্থানের মধ্যে দিয়ে ব্যবিলনের পথে রওনা হন।

আলেকজান্ডার তার বিজিত অঞ্চল সমূহকে ৭টি প্রদেশে বিভক্ত করেছিলেন। এদের পাঁচটি ভারতীয় এবং অপর দু‘টি উপমহাদেশের বাইরে। ভারতীয় ৫টি প্রদেশের দু‘টিতে পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে তিনি গ্রীক গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন এবং অপর তিনটিতে ভারতীয় গভর্নর নিযুক্ত হযেছিল।

আলেকজান্ডার যখন পাঞ্জাবে অবস্থান করছিলেন, সেইসময় চন্দ্রগুপ্ত তার সাক্ষাৎপ্রার্থী হন। যে উদ্দেশ্যে চন্দ্রগুপ্তের এই মিশন তা হল মগধরাজ ধননন্দকে সিংহাসনচ্যূত করতে আলেকজান্ডারের সহায়তা লাভ। সুতরাং চন্দ্রগুপ্ত ধননন্দের প্রতি প্রজাসাধারণের ঘৃণা ও বীতশ্রদ্ধার কথা আলেকজান্ডারের কাছে তুলে ধরেন এবং সাথে সাথে প্রজাসাধারণের পক্ষ থেকে ধননন্দকে উৎখাতে সাহায্য সহযোগীতার প্রতিশ্রুতিও দেন।

চন্দ্রগুপ্তের এই মিশন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হল। গ্রীক সহায়তা লাভের বদলে নিজের মৃত্যুদন্ডাদেশ কাঁধে নিয়ে তিনি পলায়ন করে কোনরকমে নিজ প্রাণ রক্ষা করেন। চন্দ্রগুপ্ত তার নির্ভিক ও তেজোদীপ্ত আচরণের জন্যে আলেকজান্ডার কর্তৃক মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রাপ্ত হয়েছিলেন।

চন্দ্রগুপ্ত ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত ছিলেন। কোন এক যুদ্ধে তার পিতা মারা গেলে তার মাতা মূরা দেবী বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এবং অন্ত:সত্ত্বা অবস্থায় মগধের রাজধানী পাটালীপুত্রে আশ্রয় গ্রহণ করেন। চন্দ্রগুপ্ত সেখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মূরাদেবীর আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায় এক রাখাল চন্দ্রগুপ্তকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করে। চন্দ্রগুপ্ত এই রাখালের গৃহে কিছুদিন লালিত-পালিত হন। অত:পর বালক চন্দ্রগুপ্তের রাজসদৃশ চেহারা ও বুদ্ধিমত্তা লক্ষ্য করে তাকে তক্ষশীলার এক ব্রাহ্মণ চানক্য যিনি বিষ্ণুগুপ্ত ও কৌটিল্য নামেও পরিচিত, সঙ্গে করে নিয়ে যান এবং তাকে রাজনীতি ও সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে থাকেন। এর কারণ ছিল এই যে, এই কৌটিল্য প্রকাশ্য রাজদরবারে একবার নন্দরাজ কর্তৃক অপমানিত হয়েছিলেন।

ধননন্দের পিতৃশ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার জন্যে একজন ব্রাহ্মণের প্রয়োজন হয়। তখন মন্ত্রী শকটার কৌটিল্য বা চাণক্যকে ঐ শ্রাদ্ধে পৌরহিত্য করার জন্যে আমন্ত্রণ জানান। তারপর যখন কৌটিল্য রাজপ্রসাদে উপস্থিত হয়ে প্রধান পুরোহিতের আসন গ্রহন করেন, তখন কুৎসিৎ কদাকার চেহারার কৌটিল্যকে দেখে ধনানন্দ ভীষণ ক্রুদ্ধ হন। তিনি তাকে টিকি ধরে তার আসন থেকে টেনে তুলে ঘেটি ধরে রাজপ্রাসাদ থেকে বের করে দেন। আর কৌটিল্য এই অপমানের প্রতিশোধ নেবার প্রতিজ্ঞা করেন এবং ব্রত পালন করতে থাকেন।

চন্দ্রগুপ্ত আলেকজান্ডারের সাহায্য লাভে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে সেনাবাহিনী সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন এবং কূটবুদ্ধি সম্পন্ন ব্রাহ্মণ চানক্যের সহযোগীতায় পার্শ্ববর্তী প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যগুলো থেকে সেনা সংগ্রহ করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিন্ধ্যা পর্বতে একদক্ষ সেনাদল গড়ে তোলেন। এই সেনাবাহিনী শক, যবন, কিরাত, কম্বোজ প্রভৃতি জাতির যোদ্ধা দ্বারা গঠিত হয়েছিল।

৩২৪ বিসিই চন্দ্রগুপ্ত তার সেনাবাহিনী নিয়ে মগধ আক্রমণ করেন। এই সংঘর্ষে নন্দরাজ পরাজিত ও নিহত হলে চন্দ্রগুপ্ত মগধের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন এবং কৌটিল্য হন তার উপদেষ্টা।

আলেকজান্ডার তার বাহ্যিক সাফল্যগুলির দ্বারা বিমোহিত হয়ে, তার আদর্শ সমূহকে বিসর্জন দিয়েছিলেন। এরূপে পূর্বাঞ্চলে তার শেষ বৎসরগুলিতে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পূর্ণরূপে পাল্টে গিয়েছিল। তিনি তার চারপাশের বিভিন্ন প্রলোভন দ্বারা দারুনভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানে আসক্ত এবং এক ধরণের জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই জ্বরই তার মৃত্যুর কারণ হল। 

বাবিলে ৩২৩ বিসিই বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার মৃত্যুবরণ করেন। এসময় তার বয়স ছিল মাত্র ৩৩ বৎসর। এত অল্প বয়সী হলেও ইতিমধ্যেই তিনি এক যুগান্তকারী ইতিহাস সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন।


আলেকজান্ডারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার শোভাযাত্রা।
আলেকজান্ডার যখন মৃত্যুবরণ করেছিলেন তখন তার উত্তরাধিকারী হওয়ার মত এমন কোন শক্তিশালী লোক ছিলেন না যিনি তার বিজিত বিশাল সাম্রাজ্য একত্রে ধরে রাখতে পারেন। তার মৃত্যুরপর তাকে সমাধিস্থ করার পূর্বেই তার সেনাপতিদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়ে যায়। তার এই সাম্রাজ্য অত:পর তার চারজন সেনাপতির মধ্যে ভাগ হয়ে গেল। এই সেনাপতিরা হলেন টলেমি, লাইসিয়াস, কাসেন্ডার এবং সেলুকাস। আর এই বিভাগগুলি ছিল পশ্চিমাঞ্চল অথবা গ্রীস, উত্তরাঞ্চল অথবা আর্মেনিয়া, পূর্বাঞ্চল অথবা সিরিয়া এবং দক্ষিণাঞ্চল বা মিসর। সেলুকাসের শাসনাধীনে সিরিয়া বা পূর্বাঞ্চলের অংশে পড়েছিল পাঞ্জাব, সিন্ধু, পারস্য ও প্যালেষ্টাইনের উত্তরাঞ্চল। টলেমীর শাসনাধীন দক্ষিণাঞ্চল বা মিসরীয় ভাগের অন্তর্ভূক্ত ছিল প্যালেস্টাইনের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল। বস্তুতঃ প্যালেস্টাইন সেলুকাস এবং টলেমি এই দু’শক্তির মাঝে পড়েছিল।
 
সেলুকাস তার রাজ্যে গ্রীসের অনুরূপ নগর রাষ্ট্র গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছিলেন যার অন্যতম ছিল দজলা বা টাইগ্রিসে অবস্থিত সেলেওসিয়া। এখানে তিনি পশ্চিমা দেবদেবীদের মূর্ত্তি স্থাপন করেছিলেন এবং পশ্চিমা শিল্পকলা ও চিন্তাধারার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন।

আলেকজান্ডারের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই চন্দ্রগুপ্ত গ্রীক শাসকদের বিতাড়নের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। প্রথমে নন্দ বংশের উচ্ছেদ সাধন করে তিনি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তার রাজ্য বিস্তার অব্যহত রাখেন। একই সঙ্গে একের পর এক গ্রীক অধিকৃত অঞ্চলসমূহ জয় করে পাঞ্জাবের নিকটবর্তী হন। আলেকজান্ডারের নিয়োজিত গ্রীক শাসনকর্তা সেলিওকাস তাকে দমন ও বিজিত রাজ্যসমূহ পুন:রুদ্ধার করতে ৩০৫ বিসিই সিন্ধুতে এসে পৌছিলে চন্দ্রগুপ্ত কর্তৃক প্রচন্ড বাঁধার সম্মুখীন হন। এতে সেলিওকাস চন্দ্রগুপ্তের সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন। সন্ধির আশু শর্তানুসারে সেলিওকাস চন্দ্রগুপ্তকে কাবুল, কান্দাহার, হিরাট ও মাকরান প্রদেশ ছেড়ে তো দিলেনই উপরন্তু নিজকন্যা হেলেনের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের বিবাহ দিয়েছিলেন। অন্যদিকে বন্ধুত্বের নিদর্শণ স্বরূপ চন্দ্রগুপ্ত সেলিওকাসকে পাঁচশত হাতি উপহার দেন। দীর্ঘ ২৪ বৎসর রাজত্বের পর ৩০০ বিসিই এই চন্দ্রগুপ্ত অবশেষে মহীশুরের শ্রাবণ বেলগোলা নামক স্থানে অনশনে মৃত্যুবরণ করেন।
Read More

ইতিহাসঃ আলেকজান্ডার ও রুক্সানা

February 17, 2018 0

 


সগডিয়ানার পাথর দুর্গের উপর থেকে অক্সিয়ার্টেস আর তার দলবল আচমকা তীর মেরে ছত্রভঙ্গ করে দেয় আক্রমণকারী আগন্তুক পশ্চিমা বীর যোদ্ধার পুরো সৈন্যদলকে। পশ্চিমা যোদ্ধা তার রাজ্যবিস্তার করতে গিয়ে বহু জাতিকে নিমিষেই ধ্বংস করে দিয়েছে, বহু জাতি নিজ থেকে এসে তার পদতলে লুটিয়ে পড়েছে। কিন্তু এই পোষ না-মানা গোত্রকে কোনো ভাবেই কব্জা করা যাচ্ছে না, তুষারাবৃত খাড়া পাহাড়ের চূড়ায় সুরক্ষিত দুর্গে বসে ক্ষণে ক্ষণে তারা শুধু তীর-ধনূক নিয়ে আক্রমণ করে যাচ্ছে। একপর্যায়ে সগডিয়ানানরা হুঙ্কার ছেড়ে বললো, “সগডিয়ানার দুর্গ জয় করবে, সে-রকম বীরপুরুষের জন্ম এখনো এই ভূখন্ডে হয়নি, তোমাদের কারো যদি পাখা গজিয়ে থাকে, তবে উড়ে আসো।” তারপর একযোগে ঠাট্টার হাসি হেসে সগডিয়ানার বাসিন্দারা ফিরে যায় দুর্গের ভিতরদিকটায়।

রাতের অন্ধকার নেমে আসলে অক্সিয়ার্টেস আপন মনে ভেবে যায় তার নিজ দেশের কথা; সমরখন্দ, বোখারা, বলখ্, আমু দরিয়া, সির দরিয়ার তীরে গড়ে উঠা তার নিজ রাজ্যের জাতিগোষ্ঠীর কথা, প্রতিবেশী জাতিগোষ্ঠীর কথা; তার শৈশব, কৈশর, যৌবনের নানা রঙের দিনগুলোর কথা। পশ্চিমা এই যোদ্ধা অভিযান পথে সবকিছু তছনছ করে, নামকরা সব যোদ্ধাদের পরাজিত করে, আজ পদানবত করতে এসেছে সগডিয়ানা রাজ্যকে। নিজ অঞ্চল ব্যাক্ট্রিয়া থেকে দূরে সরে, স্ত্রী-কন্যা-পরিবার-পরিজন নিয়ে বিপদের কালে আজ অক্সিয়ার্টেস এসে আশ্রয় নিয়েছে বহুদিনের নামকরা, নির্ভয় আশ্রয়স্থল পাশের রাজ্য সগডিয়ানার এই সুরক্ষিত দুর্গে। শুধু সগডিয়ানার ছোট্ট কিশোর ‘আফসিন’, যে এখনো জানে না যুদ্ধ কি জিনিস, মনের আনন্দে সে রাতের তারা গুণে যাচ্ছে আপন মনে, এক-দুই-তিন-চার পাঁচ-ছয়-সাত।

ওদিকে, রাতের তারার আলোয় পশ্চিমা বীর যোদ্ধা তার সৈন্যদলকে উজ্জ্বীবিত করতে ঘোষণা করল- যারা এই খাড়া পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দুর্গে পৌঁছাতে পারবে তাদেরকে মহামূল্যবান পুরস্কারে ভূষিত করা হবে। দুঃসাহসী আর পর্বতারোহণে সক্ষম সৈন্যদের মধ্য থেকে সকালের মধ্যেই খুঁটি-দড়ি নিয়ে প্রায় তিনশ জন উঠে গেলো দুর্গচূড়ায়, যদিও আরোহণের সময় ছিটকে পড়ে মৃত্যুবরণ করলো ত্রিশজন। হতভম্ব অক্সিয়ার্টেস আর তার দলবলকে দেখিয়ে দেয়া হলো পাখা গজানো পশ্চিমা যোদ্ধাদের, প্রয়োজন হলে যারা উড়তেও পারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমগ্র দূর্গ পশ্চিমা যোদ্ধার দখলে চলে যায়। সগডিয়ানা দুর্গে পরিভ্রমনরত বিজয়ী বীরযোদ্ধা হঠাৎ এসে উপস্থিত হলেন অক্সিয়ার্টেসের আঙ্গিনায়। বহুদেশের বহু সুন্দরী, রূপসী দেখে অভ্যস্ত হলেও কেন জানি এই সগডিয়ানার রূপসীকে দেখে তার চোখ আটকে গেল। নিজের দরজায় দাঁড়িয়ে ভিনদেশি এই সাহসী যোদ্ধাকে এক নজর দেখছিলো রূপসী ‘রুকসানা’। ‘রুকসানা’নামের অর্থ আকাশের ছোট্ট তারা, ঠিক সেরকম তারা হয়েই যেন বীর যোদ্ধার চোখে ভেসে থাকলো ‘রুকসানা’।

ওদিকে, অনেক দূর থেকে রাজ্য জয় করতে আসা যোদ্ধা বুঝতে পারে, দূরদেশের এই জনগণকে শূধু তাদের রাজ্য জয় করলেই বশে আনা যাবে না, তাদের সাথে সেতুবন্ধ গড়ে তুলতে হবে। তাই সসন্মানে রুকসানার পিতা অক্সিয়ার্টেসকে তার নিজ অঞ্চলসহ আরো বৃহৎ অংশের অধিপতি নিয়োগ করলো। তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে যোদ্ধা ও তার সৈন্যদল সে অঞ্চলের প্রথা অনুসরণ করে তাদের মত করে পোশাক পরিধান করতে লাগলো। উপরন্তু, অপরাপর সমস্ত সেনাপ্রধান এবং নিজদেশীয় পরিজনদের মতামতকে অগ্রাহ্য করে খেয়ালী এই বীর যোদ্ধা সগডিয়ানার ছোট্ট তারা ‘রুকসানা’কে নিজের প্রথম স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবার জন্য মনস্থির করে ফেললো। স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী এক টুকরা রুটি তলোয়ার দিয়ে কেটে দুই টুকরা করে বর ও কনেকে খাওয়ানোর মাধ্যমে বিবাহ সুসম্পন্ন হলো; সাথে সাথে রাজার বিয়ের দিনে সেনাবাহিনীর আরো দশ হাজার সৈন্য স্থানীয় কন্যাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। স্থানীয় নিয়মানু্যায়ী বাসর শয্যায় নতমুখে বসে থাকা রূপসী রুকসানাকে ফুলের মালা গলায় দিয়ে বরণ করে নিলো পশ্চিমা বীর যোদ্ধা।



ছবিঃ রুকসানা (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

কিছুদিনের মধ্যেই আমুদরিয়া নদীর তীরে বেড়ে উঠা, ৩৪৩ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেয়া প্রাচ্যদেশীয় মেয়ে রুকসানা বুঝতে পারে, পশ্চিমা এই বীর যোদ্ধা যে-ভালোবাসা দেখিয়ে তাঁকে বিয়ে করেছিলো, সে-ভালোবাসা শুধু তার একার জন্য নয়। আক্রমণ পথে নিজের সাথে করে রাজসেবিকা করে নিয়ে এসেছে পরাজিত সম্রাটদের কন্যাদের। কিন্তু ভাগ্যাহত রুকসানা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি, তার বীরপুরুষ উনত্রিশ বছর বয়স্ক স্বামীর ভালোবাসায় ভাগ বসাতে আসবে সুন্দরী অপর কোনো রাজকন্যা নয়, বরং পশ্চিমা দেশিয় এক পুরুষ – ‘হেফাইশ্চিয়ান’ তার নাম। বীর যোদ্ধার বিয়েতে সবচেয়ে বেশি মর্মাহত হয়ছে, সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছে এই হেফাইশ্চিয়ান।

রুকসানা নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকে, উঠতে বসতে চলতে ফিরতে যদি হেফাইশ্চিয়ান-ই থাকবে যোদ্ধার সাথে সাথে, তবে কেন তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়া। অন্য আর পাঁচ-দশটা মেয়ের মত তাকেও রাজসেবিকা করে রাখলেইতো পারে। রাগে, ক্ষোভে, অভিমানে রুকসানা প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করে বীর যোদ্ধাকে। কিন্তু রাজ্যের পর রাজ্য জয় করে যে যোদ্ধা আজ তার কাছে এসেছে, তাকে কি আর রাগ, ক্ষোভ, অভিমান দিয়ে জয় করা যায়? দিনের পর দিন সে যোদ্ধা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ দেখেই অভ্যস্ত। একই ধারায় আত্মসমর্পিত রুকসানা বুঝতে পারলো, শুধু রাজ্যের পর রাজ্য জয় করলে হয় না, সে রাজ্য রক্ষা করার জন্য দরকার হয় ভবিষ্যত বংশধর। যে সাহস আর ক্ষিপ্রতা যোদ্ধা রুকসানা ভেতর দেখেছিলো, তাতেই তার মনে হয়েছে, তার অনাগত বীর সন্তানের মা হবার জন্য এর চেয়ে যোগ্য নারী আর কেউ হতে পারে না। সৌন্দর্য আর সাহসের সন্মিলনে যে রুকসানার সৃষ্টি, তাকে অবহেলায় ফেলে রেখে যায় সে সাধ্য কোন বীরপুরুষের। অদম্য সেই মহাপরাক্রমশালী যুদ্ধরাজ রুকসানাকে সাথে নিয়ে এবার পাড়ি জমালেন আরো পূর্বে, স্বপ্ন তার পৃথিবী জয় করবার, রাজ্য জয় করে করে সে দেখতে চায় পৃথিবীর শেষটা ঠিক কোথায়।

দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সৈন্যবাহিনী সাথে নিয়ে অগ্রসর হয়ে যোদ্ধা এবার উপস্থিত হয় নতুন এক রাজ্যে। নিজ জন্মভূমি থেকে হাজার মাইল দূরে অনেক পূর্বের এই ভিনদেশি রাজ্যে এসে অবাক হয়ে যায় যোদ্ধা। কত ভিন্ন এই জাতি, কত অদ্ভূত তাদের আচার-আচরণ রীতি-নীতি। কিন্তু সবকিছুর চেয়ে সবচেয়ে বেশি অবাক করার বিষয় হলো এ-জাতির সাহস, দুঃসাহসী বললেও কম বলা হবে। শত শত নগর বন্দর অনায়াসে ধূলোয় মিশিয়ে দিয়ে এসেও ব্যতিক্রমী এই রাজ্যে এসে যোদ্ধা প্রথম বুঝতে শুরু করেন সবকিছু অত সহজে অর্জন করা যায় না। যুদ্ধজীবনে বহুরকমের সৈন্যদলের সাথে যুদ্ধ করে আসলেও এই প্রথম বীর যোদ্ধা তার সৈন্যদলসহ দেখতে পেলো অপরাজেয় হস্তীবাহিনী। কোথা থেকে এলো এত হাতী আর কোথা থেকে এলো এত যোদ্ধা। দিনের পর দিন যাদেরকে শুধু উপজাতীয় বর্বর গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে, অবাক যোদ্ধা আজ সে জাতির বীরত্ব আর কৌশল দেখছে। জীবনে প্রথমবারের মত ব্যতিক্রমী এ-জাতি নতুন করে তাকে চিন্তা করতে বাধ্য করালো। শুধু যুদ্ধ নয়, এ-জাতির আচার-আচরণ, চাল-চলন, আকৃতি-প্রকৃতি, এ-স্থানের পর্বত, সমুদ্র, নদী সমস্ত কিছুই একের পর এক তাকে উপহার দিয়ে যাচ্ছে বিস্ময়ের পর বিস্ময়। বিস্ময়াভিভূত যোদ্ধা মাতৃভূমি থেকে হাজার মাইল দূরের স্থানীয় ঝিলম নদীর তীরে দাঁড়িয়ে নিজ থেকে বলে উঠলো, ‘বিচিত্র এই দেশ সেলুকাস। বিচিত্র এ-দেশের মানুষগুলো।’ অফিসার থেকে সদ্য একাংশের সেনাপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সেলুকাস উত্তর দেয়, ‘সত্যিই বিচিত্র এই দেশ আলেকজান্ডার, মাই লর্ড’।

মহাবীর আলেকজান্ডার, আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট। জীবনের বারোটি বছর ধরে, চল্লিশ হাজার সৈন্য নিয়ে, বাইশ হাজার মাইল অতিক্রম করে আজ ঝিলম নদীর তীরে দাঁড়িয়ে প্রথমবারের মত চিন্তা করছে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যাবার কথা। ৩৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ২০শে জুলাই গ্রীসের উত্তরপূর্ব প্রদেশ মেসিডোনে জন্ম নেয় আলেকজান্ডার, তার মা অলিম্পিয়াস কখনোই স্বীকার করেনি যে আলেকজান্ডার তার কাগজে কলমের বাবা বহুস্ত্রীর অধিকারী রাজা ফিলিপের সন্তান। বছরের পর বছর অলিম্পিয়াস আলেকজান্ডারকে বুঝিয়েছে সে দেবতা জিউসের সন্তান। দার্শনিক এরিস্টটলের ছাত্র, পৌরাণিক চিন্তা-ভাবনায় বিশ্বাসী মা এবং যুদ্ধবাজ বাবার সন্তান আলেকজান্ডার ছোটবেলা থেকেই তাই বেড়ে উঠেছে একটু আলাদাভাবে। শিক্ষক এরিস্টটলের কাছে পৃথিবীর মানচিত্র শিখে এসে, প্রিয় লেখক হোমারের কবিতা পড়তে পড়তে ঘুমোতে যাবার আগে আলেকজান্ডার স্বপ্ন দেখতো একদিন ঠিকই সে পৌঁছে যাবে পৃথিবীর শেষ সীমানায়।

যুদ্ধে এক চোখ হারিয়ে ফেলা আলেকজান্ডারের পিতা রাজা ফিলিপের স্বপ্ন ছিলো একদিন গ্রিস, মেসেডোনিয়ার সীমান্ত পার হয়ে পারস্য জয় করবে। কিন্তু, কে হবে ফিলিপের উত্তরসূরী আর এত বড় সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী? একদা সদ্য বিবাহ করে আসলে, বিবাহ উপলক্ষ্যে করা ফিলিপের পানাহারের আসরে নতুন রানীর বয়োজ্যেষ্ঠ অভিভাবক, সে প্রশ্ন তুলে উস্কানিমূলক মন্তব্য করতে গেলে তার মুখে সুরার পাত্র থেকে সুরা ছুঁড়ে মারেন আলেকজান্ডার। উত্তপ্ত, মাতাল ফিলিপ তলোয়ার নিয়ে ছেলেকে শায়েস্তা করতে আসার সময় এক কদম এগিয়েই মেঝেতে ঢলে পড়েন। সে-দিন আলেকজান্ডার বাবাকে তিরস্কার করে বলেছিলো, “যে রাজা এক কদম পার হতেই পরাস্ত হয়, সে রাজা কি করে স্বপ্ন দেখেন গ্রিস পার হয়ে পারস্য আক্রমণ করার।”

উচ্চাভিলাষী মা অলিম্পিয়াস সবময় সুযোগে থেকেছে কি করে অন্য আর সব উত্তরাধিকারীকে নিশ্চিহ্ন করে ছেলে আলেকজান্ডারকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা যায়। তারই ধারাবাহিকতায় প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে ৩৩৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, তার বিশ্বস্ত সাতজন দেহরক্ষীদর একজন এবং পুরুষ শয্যাসঙ্গী ‘পসানিয়াস’র হাতে নিহত হন রাজা ফিলিপ। নিজের সন্মুখে বাবার এই অপমৃত্যু আলেকজান্ডার খুব সহজভাবে মেনে না নিলেওও মাত্র বিশ বছর বয়সে পিতার অপমৃত্যুর মধ্য দিয়ে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয় সম্রাট আলেকজান্ডার। মেসিডোনিয়ান অন্যসব রাজ্যের যুবরাজসহ সিংহাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্ভাব্য সবধরণের ব্যক্তি, যারা ভবিষ্যতে সিংহাসনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে, তাদের সবাইকে খুন করানোর মধ্য দিয়ে আলেকজান্ডার তার রাজ্য পরিচালনা শুরু করে। ওদিকে, মা অলিম্পিয়াস আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেন ফিলিপের অন্য স্ত্রী এবং তার শিশু সন্তানকে, যার কারণে আলেকজান্ডার মায়ের উপর ক্ষিপ্তও হয়।

সিংহাসনে স্থির হয়ে বসার পর এবার বিশ্বজয়ের পালা। নিজ রাজ্যের থীবস্ এবং এথেন্স্ এর বিদ্রোহ দমন করে ৩৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চল্লিশ হাজার সৈন্য নিয়ে পারস্য আক্রমণ করার অভিপ্রায়ে আলেকজান্ডার এশিয়া ও ইউরোপের মিলনস্থল ‘হেলিস্পন্ট’ নামক জায়গা অতিক্রম করে। প্রাথমিক পর্যায়ে ‘ইসাস্’ এর প্রান্তরে সংঘটিত যুদ্ধে পারস্যের মহাপরাক্রমশালী সম্রাট ‘দ্যারিয়ুস’কে পরাজিত করে তার শক্তিমত্তার জানান দিলেও দ্যারিয়ুসকে আটক করতে ব্যর্থ হয় আলেকজান্ডার । এর পরের অভিযানে সবচাইতে বড় বাঁধার মুখে পতিত হন ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী দ্বীপ টায়ারএ(লেবানন)। চারপাশে প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষিত দ্বীপে নৌ-আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে, প্রায় সাত মাস ধরে অবরুদ্ধ করে রেখে অবশেষে আলেকজান্ডার সমুদ্রের উপর দিয়ে একমাইল দীর্ঘ দ্বীপে যাওয়ার পথ তৈরী করতে সক্ষম হয়। দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিজে হাতে আসার পর আলেকজান্ডার ও তার সৈন্যরা যুদ্ধ করতে সক্ষম ছয় হাজার টায়ারবাসীকে তরবারি দিয়ে কেটে টুকরা টুকরা করে, দুইহাজারজনকে সমুদ্র সৈকতে ক্রুশবিদ্ধ করে আর বাকী ত্রিশ হাজার নারী, বৃদ্ধ, শিশুকে দাস হিসেবে বিক্রি করে অন্য রাজ্যগুলিতে।

টায়ার বিজয়ের পর আলেকজান্ডার অল্পকিছুদিনের জন্য মিশর যাত্রা করে। যাত্রাপথে জেরুজালেমসহ অন্যসব শহর তার কাছে আত্মসমর্পণ করে, শুধুমাত্র পাহাড়ের উপর অবস্থিত দূর্গদিয়ে সুরক্ষিত ‘গাজা’ শহর আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু খুব সহজেই ‘গাজা’ জয় করার পর আবারো আলেকজান্ডার শহরের সমস্ত পুরুষদের হত্যা করে অন্যদের দাস হিসেবে অন্যত্র বিক্রি করে দেয়। ওদিকে, রাজ্য হারিয়ে অসহায় পারস্য সম্রাট দ্যারিয়ুস আবার শক্তি সঞ্চয় করে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ‘গগামেলা’র প্রান্তরে সেই যুদ্ধে প্রতিপক্ষের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে জেনারেল ‘পারমেনিয়ন’ ও অন্যান্য উপদেষ্টাবৃন্দ রাতের অন্ধকারে আক্রমণ চালানোর জন্য সুপারিশ করে। জবাবে আলেকজান্ডার বলে, ‘আমি আমার নিজের বিজয় নিজেই রাতের অন্ধকারে চুরি করতে চাই না।’ আরো বলে, ‘আমি যদি পারমেনিয়ন হতাম, আমি তাই করতাম; কিন্তু আমি আলেকজান্ডার।’ যুদ্ধে সময়মত জয় ছিনিয়ে নিলেও আবারো দ্যারিয়ুসকে বন্দী করতে ব্যর্থ হয় আলেকজান্ডার।



ছবিঃ আলেকজান্ডার (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

এ-পর্যায়ে আলেকজান্ডার নিজেকে এশিয়ার রাজাদের রাজা তথা শাহেনশাহ্ ঘোষণা করে। সাথে সাথে পারস্যের স্থাপনা আর সংস্কৃতি দেখে হতবাক হয়ে যায় আলেকজান্ডারবাহিনী। যুগ যুগ ধরে তারা অযথাই ধারণা করে এসেছে, এই পারস্য বর্বর আর যাযাবরদের রাজ্য। কিন্তু, সবচাইতে লাভজনকভাবে আলেকজান্ডার এই পারস্য থেকে লুট করার জন্য পেয়ে যান প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ কিলোগ্রাম স্বর্ণ, যেই স্বর্ণ বহন করার জন্য তাকে নিয়োজিত করতে হয়েছে ছয় হাজার সৈন্য। এক রাতেই আলেকজান্ডার পরিণত হয় ইতিহাসের সবচাইতে ধনী ব্যক্তিতে। নতুন অর্থ, নতুন সংস্কৃতি; এবার দলবল নিয়ে পারস্যের সংস্কৃতিতে মুগ্ধ আলেকজান্ডার নিজেই সেটা চর্চা করতে শুরু করে দেয়, কিন্তু ভিনদেশীয় সংস্কৃতি গ্রহণে বাধ্য করায় তার স্বদেশিয়দের মাঝে বিরাগভাজন হয়ে উঠে। এরই ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে, রাজদ্রোহিতা ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে তার উর্ধ্বতন অফিসার ‘ফিলোটাস’কে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে এবং ছেলেহত্যার প্রতিশোধ নিতে পারে সন্দেহ করে, অত্যন্ত বর্বরোচিতভাবে তার নিজের ও পিতা ফিলিপের বহুদিনের সমরসঙ্গী, ফিলোটাসের পিতা ‘পারমেনিয়ন’কে খুন করে। কিন্তু, ফিলোটাসের প্রকৃত অপরাধ ছিলো মদ্যপ অবস্থায় সে তার এক শয্যাসঙ্গীনির কাছে বড়াই করে বলে ফেলেছিলো, আলেকজান্ডারের এত রাজ্য জয়ের পেছনের একমাত্র কারণ হলো ফিলোটাস নিজে এবং তার পিতা পারমেনিয়ন। মদ্য পান করে মাতাল হয়ে থাকা আলেকজান্ডার শুধুমাত্র এক রাজগণিকার মনোরঞ্জনের অভিপ্রায়ে সেখানকার মনোরম রাজপ্রাসদে আগুন ধরিয়ে ধ্বংস করে এবং সমস্ত শহর লুটপাট করে তছনছ করে তার সৈন্যরা, পরবর্তী সকালে প্রকৃতিস্থ আলেকজান্ডার নিজের কৃতকর্মে নিজেই ব্যথিত হয়। কিন্তু, সবকিছুকে স্তব্ধ করে দিয়ে মদ্যপ আলেকজান্ডার তর্ক করতে করতে, একদা তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো ব্যক্তি ‘ক্লাইটাস’কে নিজ হাতে খুন করে বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাসে এক অনন্য নজির স্থাপন করে।

এদিকে, সম্রাট দ্যারিয়ুস পালিয়ে বাঁচলেও আলেকজান্ডার তার পিছু নেন যে-কোনো মূল্য বন্দী করার জন্য। দ্যারিয়ুসের পরিবার তথা স্ত্রী-কন্যা-পুত্র আলেকজান্ডারের কাছে বন্দী। আলেকজান্ডার হাজার হাজার সাধারণ মানুষের গলা কেটে ফেলতে দ্বিধাবোধ না করলেও রাজপরিবারের সাথে সবসময় সন্মানজনক ব্যবহার করতো। টায়ার দ্বীপে সমস্ত শহরবাসীকে ধ্বংস করে দিলেও রাজপরিবারকে ক্ষমা করে দেয় আলেকজান্ডার। দ্যারিয়ুসকে বন্দী করার ইচ্ছা তার ছিলো, কিন্তু মেরে ফেলার অভিপ্রায় তার হয়তো ছিলো না। ভাগ্যের পরিহাসে আলেকজান্ডারের বাহিনি যখন দ্যারিয়ুসের নিকট যখন পৌঁছায়, তার এক বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি ‘বেসাস’র হাতে নির্মমভাবে আক্রান্ত হয়ে দ্যারিয়ুস তখন মৃতপ্রায়। মৃত্যুপথে আলেকজান্ডারের বাহিনীর কাছে পানি চেয়ে অনুরোধ করে এবং পিপাসার্ত দ্যারিয়ুস পানি পান করার পরপরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তবে মৃত্যুর আগে বলে যান জীবনের শেষ বাক্য- “জীবনে এই প্রথম আমি কারো কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করলাম, যার প্রতিদান দিতে পারলাম না।” পরবর্তীতে রাজ্যহারা নিজ সম্রাটের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা বেসাসকে বন্দী করে, সুবিশাল দুটি বৃক্ষেকে কাছে টেনে তার সাথে দুই হাত বেঁধে ঝুলানোর নির্দেশ দেন আলেকজান্ডার। তারপর সেই দুই বৃক্ষকে দু’দিকে ছেড়ে দিলে দ্বিখন্ডিত হয়ে মৃত্যু বরণ করে বেসাস।



ছবিঃ আলেকজান্ডারের অভিযান পথ এবং জয়কৃত রাজ্য সমূহ (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

পৃথিবীর শেষ প্রান্ত জয় করার অভিপ্রায়ে আলেকজান্ডার এবার আরো পূর্বে যাত্রা শুরু করে এবং সগডিয়ান রাজ্যে স্ত্রী হিসেবে তার জীবনে আসে রুকসানা। রুকসানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতবর্ষ আক্রমণকারী আলেকজান্ডার আজ ঝিলম নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ভাবছে, এবার কি ফেরত যাওয়া উচিৎ নিজের রাজ্যে, যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলো, সেই মেসিডোনিয়ায়। ভারতবর্ষের স্থানীয় হিন্দু রাজা ‘পুরু’ অসীম সাহস আর বীরত্ব দেখিয়ে যুদ্ধ করে প্রায় পরাস্তই করে ফেললো আলেকজান্ডার বাহিনীকে। কিন্তু শেষ রক্ষা আর করতে পারলো না। পুরু পরাজিত হলেও আলেকজান্ডারের সৈন্যবাহিনী আর যুদ্ধ করতে চাইলো না। তারা বুঝে গিয়েছিলো এ জাতি কোনো সাধারণ জাতি নয়। সম্রাট পুরু প্রতিরোধের যে নিদর্শন দেখিয়েছে এর পরও অগ্রসর হওয়াটা বোকামি। পরবর্তী রাজ্য গঙ্গার অববাহিকায় গড়ে উঠা ‘নন্দ’ এবং বঙ্গের সুবিখ্যাত ‘গঙ্গারিডাই’। বঙ্গের সীমানায় এসে, কি-জানি হয়তো এ-জাতির পারিবারিক স্নেহ-মায়া-মমতার নিদর্শন দেখেই আলেকজান্ডারের সৈন্যবাহিনীর বছরের পর বছর ধরে পিছনে ফেলে আসা তাদের নিজ পরিবার, স্ত্রী-কন্যা-পুত্রদের কথা মন পড়ে গেলো। তারা বিদ্রোহ করে বসলো, অনেক হয়েছে আর নয়। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আলেকজান্ডারও সিদ্ধান্ত নিলো এবং অবশেষে নির্দেশ দিলো বাড়ী ফেরার।

বাড়ী ফেরার জন্য দলবল নিয়ে দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করে আলেকজান্ডার। উদ্দেশ্য অর্ধেক জনবল সমুদ্রপথে এবং বাকী অর্ধেক স্থলপথে অগ্রসর হবে। ফেরার পথে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো আক্রমণ করে সামনে এগিয়ে চলা আলেকজান্ডার এবার আক্রমণ করে মালি(মুলতান)। শহরপ্রাচীরের এক পাশে মালির সৈন্যদল আর অন্যপাশে আলেকজান্ডারের সৈন্যদল, আর প্রাচীরের উপর একা আলেকজান্ডার। হঠাৎ করে সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে বিশ্বজয়ী বীর তরবারি হাতে লাফিয়ে পড়লেন বিপক্ষ দলের মাঝে। মালির সৈন্যবাহিনীর মাঝে একা আলেকজান্ডার আর সঙ্গী মাত্র তিনজন মেসিডোনিয়ান সৈন্য। উপায় না দেখে রাজাকে বাঁচানোর জন্য মেসিডোনিয়ানরা যত দ্রুত সম্ভব প্রাচীরের অন্য পাশে পৌঁছালো। কিন্তু ততক্ষণে সঙ্গী তিনজনের দুইজনের দেহ থেকে শির আলাদা হয়ে গেছে, আলেকজান্ডার আহত হয়েছে মারাত্মকভাবে।

অসুস্থ শরীর নিয়ে ফেরার পথে হঠাৎ করে মৃত্যুবরণ করে আলেকজান্ডারের প্রিয়তম ‘হেফাইশ্চিয়ান’। হেফাইশ্চিয়ানের মৃত্যুতে উন্মাদ হয়ে যায় আলেকজান্ডার। কোনোভাবে ছাড়তে রাজী না হওয়ায় অন্যরা জোর করে তার কাছ থেকে কেড়ে নেয় মৃত হেফাইশ্চিয়ানের দেহ। সবার আগে সন্দেহের তীর যায় রুকসানার দিকে। শোকে বিহবল আলেকজান্ডার রুকসানাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলে প্রাণভয়ে কাতর রুকসানা তার গর্ভে আলেকজান্ডারের তিন মাস বয়সী সন্তান থাকার কথা বলে রক্ষা পান। কিন্তু, আলেকজান্ডার রুকসানাকে নির্দেশ দেয়, আর কখনো যেন সে তাকে স্পর্শ করতেও না আসে। দুইদিন ধরে নাওয়া খাওয়া সব ভুলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধুই চোখের পানি ফেলে আলেকজান্ডার। হাইফেশ্চিয়ানের চিকিৎসককে দেয় মৃত্যুদন্ড। পার্শ্ববর্তী শহরের সব বাসিন্দাদের হত্যা করে হেফাইশ্চিয়ানের মৃত আত্মার প্রতি উৎসর্গ করে। ব্যবিলনে তার শবদাহ করে রাজকীয় মর্যাদায়, সীমাহীন অর্থব্যয় করে। সে-দিন সমস্ত রাজ্যজুড়ে শোকদিবস পালনের নির্দেশ দেয় আলেকজান্ডার।

হেফাইশ্চিয়ানের মৃত্যুশোক কাটিয়ে উঠে আলেকজান্ডারের এবার আরব আক্রমণের পরিকল্পনা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই সুযোগ আর হয়ে উঠলো না। ৩৩২ খ্রিস্টাব্দের ১০ই জুন, জগতের অপরাপর সমস্ত বীর যোদ্ধা যেখানে আলেকজান্ডারের প্রাণ নিতে পারলো না, প্রায় সপ্তাহখানেক জ্বরে ভোগার পর মাত্র ৩২ বছর বয়সে ব্যবিলনের একসময়কার সম্রাট নেবুচাদ নেজার‘র প্রাসাদে প্রবল জ্বরের কবলে পড়ে মৃত্যুবরণ করে আলেজান্ডার। মৃত্যুর আগে কে হবে তার উত্তরাধিকারী, কার কাছে যাবে রাজ্য শাসনের ভার, সেটা বার বার করে জানতে চাওয়া হয়েছিলো আলেকজান্ডারের কাছে। কিন্তু যে বীরকে শৈশবে তার শিক্ষক এরিস্টটল শিখিয়েছেন, ‘দেখ, শোন,জান, তারপর সিদ্ধান্ত নাও’, যে বীর সমস্ত জীবন শুধু শক্তিমত্তার প্রদর্শন আর পূজা করে গেছে, সে কি আর অত সহজে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে। ‘কার কাছে যাবে রাজ্য শাসনের ভার’– তার উত্তরে আলেকজান্ডার ক্ষীণস্বরে তার সেনাপতির নাম করে বলেছিলো ‘ক্রাটিরোস’। কিন্তু ক্রাটিরোসের অনুপস্থিতিতে অন্য সেনাপতিরা সেটা পরিবর্তন করে বলে বেড়ালো –‘ক্রাটিস্টোস্’। অর্থ্যাৎ, টু দ্যা স্ট্রঙ্গেস্ট, সবচাইতে শক্তিমানের কাছে যাবে রাজ্যশাসনের ভার।

মৃত্যুর কয়েক ঘন্টার মধ্যে আলেকজান্ডারের শক্তিমান সেনাপতিরা সুবিশাল রাজ্য ভাগাভাগি নিয়ে বিবাদে লিপ্ত হয়। তলোয়ার নিয়ে একে অন্যকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। পরিস্থিতি শান্ত হলে, বিবদমান পক্ষগুলো একে অপরের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগ করে নেয়। কথা থাকে, রুকসানার পুত্র সন্তান হলে তার কাছে অর্পণ করা হবে রাজ্যভার। এদিকে প্রিয় রাজার মৃতদেহ নিজ মাতৃভূমিতে নিয়ে যাবার জন্য মেসিডোনিয়ানরা উঠে পড়ে লাগে, কিন্তু আলেকজান্ডারের সেনাপতি টলেমি বলতে গেলে লাশ ছিনিয়ে মিশর নিয়ে যায়। পরবর্তীতে কথা অনুযায়ী একসময় রুকসানা ও আলেকজান্ডারের পুত্রসন্তানকে কাগজে কলমে রাজা খেতাবও দেয়া হয়। কিন্তু আলকজান্ডারের সেনাপতি, বন্ধু, পরিবার-পরিজন যাদের নাম দেয়া হয় ‘ডায়াডকি’ তথা উত্তরসূরী, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্রে করে ইতিমধ্যেই তারা নিজেদের মধ্যে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। একের পর এক খুন হতে থাকে সেনাপতি আর উত্তরাধিকারীগণ। অবশেষে সমস্ত রাজ্য চারভাগে ভাগ হয়- মিশর, এশিয়া মাইনর, পূর্বএশিয়া এবং মেসিডন। কিন্তু, ক্ষমতার পালাবদলে এবং নিজ পুত্রের ভবিষ্যত নিষ্কণ্টক করতে এরই মাঝে রুকসানা খুন করে আলেকজান্ডারের বিবাহিতা অন্য দুই রাণীকে। পুত্রসহ নিজে সুরক্ষিত থাকে আলেকজান্ডারের মাতা অলিম্পিয়াসের তত্ত্বাবধানে।

আলেকজান্ডারের জেনারেল এবং পরবর্তীতে সাম্রাজ্যের একাংশের রাজা ‘এন্টিপেটার’, মৃত্যুকালে রাজ্যের ভার নিজ পুত্র ‘কাসান্ডার’কে না দিয়ে অন্যের হাতে তুলে দেয়। সময়মত কাসান্ডার ঠিকই রাজ্য আক্রমণ করে নিজের হাতে শাসনভার তুলে নেয় এবং যে ‘থীবস্’ নগরী ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে আলেকজান্ডার তার বিশ্বজয় শুরু করেছিলো, সেই থীবস্ নগরী পুনঃস্থাপনের মধ্য দিয়ে রাজ্য পরিচালনা শুরু করে। এক পর্যায়ে, ৩১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কাসান্ডার বন্দী করে আলেকজান্ডারের মা অলিম্পিয়াস, স্ত্রী রুকসানা এবং পুত্র চতুর্থ আলেকজান্ডারকে। কাসান্ডার অলিম্পিয়াসকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করে, কিন্তু তার সৈন্যরা সে-মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে অস্বীকৃতি জানায়। অবশেষে, অলিম্পিয়াস পূর্বে যাদেরকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছিলো তাদের স্বজনদের মাধ্যমে কাসান্ডার অলিম্পিয়াসের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করায়। অন্যদিকে, থ্রেস’র অ্যাম্ফিপোলিসে বন্দী থাকে রুকসানা আর আলেকজান্ডারের পুত্র সন্তান এবং ৩১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কাসান্ডারের নির্দেশে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় আলেকজান্ডারের শেষ বংশধর তার তের বছর বয়সী সন্তান এবং স্ত্রী রুকসানা। হাজার হাজার মাইল পূর্বে সগডিয়ানার তরুন ‘আফসিন’ রাতের বেলায় তারা গুণতে বসে। এক-দুই-তিন-চার পাঁচ-ছয়; আবার গুণে, এক-দুই-তিন-চার পাঁচ-ছয়; না, সপ্তম তারাটি আর নেই, হারিয়ে গেছে সগডিয়ানার আকাশ থেকে।
Read More

Post Top Ad