আসলে অঙ্গ, বঙ্গ এবং সুমা এই তিনটে রাজ্যের নাম আমরা পাই খৃষ্ট পুর্ব একাদশ শতাব্দীতে, যাতে এদের স্থান নির্দেশ করা হচ্ছে আর্য সভ্যতার সীমানার বাইরে, এবং সেই অনুযায়ী আমরা অঙ্গ রাজ্যকে পাচ্ছি উত্তর বাংলাতে, বঙ্গ রাজ্য কে পাচ্ছি দক্ষিন বাংলাতে এবং সুমা রাজ্যকে পাচ্ছি পশ্চিম বাংলার এলাকাতে। এখানে প্রথমেই একটা কথা মনে রাখা দরকার যে বাংলা বলতে কিন্তু আমি অবিভক্ত বাঙ্গলার কথা সব সময় বলছি।
বৈদিক যুগে আর্যরা এই তিনটি দেশের সাথে আরও একটি দেশের কথা উল্লেখ করেছিলেন যেটি হচ্ছে পুন্ড্র বা পৌণ্ড্র রাজ্য। সেই সময় বলা হচ্ছে যে এই রাজ্য গুলি নিষাদ সম্প্রদায়ের অধীনে এবং আর্যেরা এই সব জায়গাতে এলে পরে ফিরে গিয়ে নিজেদের শুদ্ধিকরণ করতেন। মহাভারতের কথা অনুযায়ী ঋষি উতথ্যের পুত্র ছিলেন দীর্ঘতামস। দীর্ঘতামস এবং রাজা বলীর রানী সুদেষ্ণার তিন পুত্র অঙ্গ, বঙ্গ এবং কলিঙ্গ। এই তিন জন তিন রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।
ভাষা হিসাবে এই সব জায়গাতে দ্রাবিড়ীয় ভাষা এবং তিব্বতীয়-বর্মী ভাষার সংমিশ্রণ ভাষার প্রচলন ছিল। এই সব ভাষার কিছু নিদর্শন আমরা কিন্তু এখনও কোল, ভীল, সাওতালী ভাষার মধ্যে দেখতে পাই।
আবুল ফজলের মতানুযায়ী বঙ্গ দেশের নাম ছিল বাং। তখনকার দিনে রাজত্বের সীমানা নির্ধারণ করে উচু মাটির দেয়াল দিয়ে গিরে রাখা হত যাকে বলা হত আল। আমরা এখনও ক্ষেতের সীমানা নির্ধারনের জন্য এই আলের ব্যবহার করি। বাং শব্দের সাথে আল শব্দ যোগ করে বাঙ্গাল শব্দ এসেছে , যেটার থেকে বাংলা ভাষা নাম হয়েছে।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার মতে বাংলা ভাষা আদি অবস্থাতে ওড়িয়া এবং আসামী ভাষার সাথে একত্রিত বা মিশ্রিত ছিল। তার থেকে প্রথমে ওড়িয়া এবং তার পরে আসামী ভাষা আলাদা হয়ে যায়। এই কারণেই চর্যাপদকে বাংলার সাথে আসামী এবং ওড়িয়া ভাষাবিদেরা তাদের আদি অবস্থা বলে মেনে নেন।
শ্রী সুনীতি কুমার চ্যাটার্জীর মতে বাংলা মগহী প্রাকৃত থেকে মগহী অপভ্রংশ হিসাবে খৃষ্টীয় দশম শতাব্দীতে উৎপন্ন হয়েছিল। আবার মহম্মদ শাহিদুল্লার মতে খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে গৌড়ীয় ভাষা থেকে উৎপন্ন হায়েছিল। ব্যকরণগত দিক থেকে যদিও বাংলা ভাষা ইন্দোইউরোপীয় ভাষা, তবুও এর উপরে দ্রাবিড়ীয় এবং তিব্বতী-বর্মী ভাষার প্রভাব সুস্পষ্ট ভাবে পড়েছে।
এবার আমরা দেখতে থাকি একে একে এই রাজ্যগুলির সম্বন্ধে আমরা কি জানতে পেরেছি। প্রথমে আমরা নিচ্ছি পৌণ্ড্র দেশ কে। বর্তমান বাংলা দেশ থেক শুরু করে বর্তমান বিহারের পূর্ণিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই রাজ্য।
মৎস্য দেশের লোকেদের ধারণা ছিল যে পৌণ্ড্র দেশের লোকেরা ম্লেচ্ছ এবং তারা ক্ষত্রিয় থেকে শূদ্র জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে এবং বৈদিক সংস্কৃতির বাইরে আছে। মহাভারতে আমরা পৌণ্ড্র রাজা পৌণ্ড্রক বাসুদেবের নাম পাই, যিনি জরাসন্ধের সাথে কৌরবদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। ইনি কৃষ্ণ বাসুদেবের হাতে মারা যান।
সুমা রাজ্য সম্পর্কে আমরা বিশেষ করে কিছু জানিনা, তবে পান্ডুপুত্র ভীম এবং অর্জুন, সুমা এবং পার্শ্ববর্তী প্রসুমা রাজ্য দুটিকে জয় করেছিলেন। সুমার অবস্থান ছিল উত্তর-পশ্চিম বাংলা এবং বিহারের কিছু অংশ।
এবার আমরা দেখি অঙ্গ রাজ্য সম্বন্ধে কি জানতে পারা গেছে। অঙ্গ রাজ্যের অবস্থান ছিল বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ, তরাই অঞ্চল, নেপাল এবং ঝাড়খন্ডের সাথে পুর্ব বিহার। বাল্মিকী রামায়ণের বাল কান্ডে বলা হয়েছে যে ইক্ষাকু বশের রাজা দশরথের কন্যা শান্তা কে অঙ্গদেশের রাজা রমাপদ (একে অনেকে চিত্ররথ নামেও জানেন) দত্তক হিসাবে নেন, এবং ঋষী ঋষ্যশৃঙ্গর সাথে শান্তার বিবাহ হয়। এই ঋষ্যশৃঙ্গ ঋষি পরে রাজা দশরথের পুত্রেষ্ঠি যজ্ঞের পুরোহিত ছিলেন। অবশ্য এর জন্য দশরথের কুলপুরোহিত বশিষ্ঠের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। বৈদিক সংস্কৃতি এই অঙ্গ রাজ্যের সীমানা পর্যন্ত এসেছিল।
মহাভারতে যেখানে কর্ণ রাজা নন বলে অর্জুন তার সাথে শক্তি পরীক্ষায় রাজী হচ্ছেন না সেখানে দুর্যোধন তাঁকে অঙ্গ রাজ্যের রাজা বলে অভিষিক্ত করেছেন। আবার পরে কর্ণ কে অঙ্গ এবং বঙ্গ দুই রাজ্যের রাজা বলা হয়েছে ।
এবারে আমরা আসি বঙ্গ রাজ্যে। বঙ্গ দেশের নাম কি করে বঙ্গ হল তা নিয়ে কিছু সন্দেহ আছে। কারুর মতে বোঙ্গা অর্থাৎ সূর্যদেবের পুজারী হিসাবে এখানকার অধিবাসীদের জন্য জায়গার নাম বোঙ্গা থেকে বঙ্গ হয়েছে। আবার কারুর মতে বঙ্গ কথাটা এসেছে ভঙ্গ থেকে। আগেই বলেছি আবুল ফজলের মতে জায়গাটার নাম ছিল বাঙ্গ। বঙ্গ রাজ্য ছিল বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে। এখানকার অধিবাসীদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে এরা সমুদ্রের দক্ষ নাবিক ছিলেন। মহাভারতে বলা হয়েছে যে এখানকার অধিবাসীরা যুদ্ধে ব্যবহৃত হাতীদের চালানতে দক্ষ ছিলেন।
রামায়ণে বলা হয়েছ যে রাম অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ জয় করেছিলেন। আবার মহাভারতে অর্জুনের বনবাসের সময় বঙ্গ দেশে আসার কথা বলা আছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বঙ্গ দেশ কৌরবদের সাথে যোগ দিয়েছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বঙ্গ দেশের রাজা ভগদত্তর সাথে ঘটোৎকচের যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে যেখানে ভগদত্ত তার পাহাড় প্রমাণ মাপের হাতী দিয়ে দুর্যোধনের রথকে ঘটোৎকচের দৃষ্টির আড়ালে রাখছিলেন।
আবার বঙ্গ দেশের রাজা বিজয় সিংহের খৃষ্ট পুর্ব ৫৪৪ সালে সিংহল জয়ের কথা আমরা মহাবংশতে পাই। শ্যাম মালয়, ইন্দোনেশিয়াতে বঙ্গদেশের অভিযানের কথা আমরা এই সমস্ত আখ্যানে পাই।
খৃষ্ট পুর্ব ষষ্ট এবং পঞ্চম শতাব্দিতে আমরা কিন্তু গঙ্গাঋদ্ধি নামে এক রাজ্যর কথা দেখতে পাই যেটা ছিল বর্তমান পশিম বঙ্গ এবং বাংলদেশের এলাকাতে। এর উল্লেখ আমরা পাই মেগাস্থিনিসের খৃষ্ট পুর্ব চতুর্থ শতাব্দীর লেখায়। টলেমীর লেখাতে আমরা পাচ্ছি যে গঙ্গাঋদ্ধি রাজ্য গঙ্গার মোহানাতে অবস্থিত।
ডক্টর আর সি মজুমদারের লিখিত পুস্তকে ডিওডোরাস সিকুলাসের বৃতান্ত থেকে আমরা জানতে পারি রাজা পুরুর ভাগ্নে আলেক্সান্ডারের আগমনের কথা শুনে রাজ্য ছেড়ে গঙ্গাঋদ্ধিতে পালিয়ে গেছেন এবং আলেক্সান্ডার তার পেছনে তাড়া করেন নি কারন ছিল গঙ্গাঋদ্ধি রাজ্যের সৈন্য বলের ক্ষমতা, যাতে কম করে ৪০০০ হাতী এবং ২০০০০ অশ্বারোহী সেনা, এবং ২০০০০০ পদাতিক সৈন্য ছিল এবং রাজ্যের পশ্চিম সীমা দিয়া গঙ্গা নদী ছিল যা আলেক্সান্দারের পক্ষে অতিক্রম করা সহজ বলে মনে হয় নি।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সময় এই গঙ্গাঋদ্ধি বা গঙ্গারদেহি রাজ্য কলিঙ্গ রাজ্যের সাথে এক হয়ে তাদের সাম্রাজ্য চেন্নাই পর্যন্ত বিস্তার করে। কিন্তু এই গঙ্গাঋদ্ধি রাজ্যের রাজধানী সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় নি। অনুমান করা হচ্ছে যে বর্তমান চন্দ্রকেতুগড় ছিল রাজধানী।
এবার আমরা আসছি ইতিহাসের বাংলা দেশের কথায়। সবাই এটা হয়তো মনে করছেন যে উপরের লেখাটুকুর সাথে ইতিহাসের কোন সংস্রব নেই। তা নয়। ইতিহাস একথা মেনেছে যে মহাভারতের যুদ্ধ হয়েছিল এবা তাতে সারা ভারতবর্ষের রাজ্যগুলি বিশেষতঃ দাক্ষিনাত্য বাদ দিয়ে বাকিটা
যোগ দিয়েছিল, এবং আলেক্সান্ডার ভারত জয়ে বেড়িয়ে পুর্ব ভারত থেকে ফিরে যান।
গুপ্ত যুগের আগে বাংলা দেশের সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের লেখা বিশেষ কিছু পাওয়া যায় নি। যা পাওয়া গেছে সেগুলো হচ্ছে কিছু কাব্য এবং লোককথার মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের টুকরো। দ্বিতীয় সমুদ্রগুপ্তের বাংলা রাজ্য জয়ের সময়ে বাংলা দেশ দুটো রাজ্যে বিভক্ত ছিল। পুস্কর্ণ এবং সমতট। পুস্কর্ণ কে আমরা পাই বর্তমান বাকুড়া জেলায় শুশুনিয়ার উত্তর পুর্বে, সমতট ছিল পূর্ব বাংলায়। পুস্কর্ণের রাজা সিংহবর্মণ এবং তার ছেলে চন্দ্রবর্মণের সময় তার রাজ্যের পুর্ব সীমা ফরিদপুর জেলা অবধি ছিল। সমতট রাষ্ট্রে খৃষ্টীয় ৫০৫ সাল নাগাদ আমরা পাই যে বৈন্যগুপ্ত স্বাধীন ভাবে সমতটে রাজত্ব করছেন এই সময় যশোহরবর্ধনের আক্রমনে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন হয়।
ষষ্ট শতাব্দীতে মহাসেনগুপ্তের সময় গুপ্ত বংশের পতনের পরে গুপ্ত সাম্রাজ্য বাংলা দেশে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। বঙ্গ, সমতট, হরিকেলা, গৌড়, বাঙ্গালা এবং কর্ণসুবর্ণ ইত্যাদি নামে। আমরা বর্তমান মানচিত্রে যদি এই রাষ্ট্রগুলিকে বসাই তবে তাদের অবস্থান এই ভাবে আমরা পাব যদিও নানান লেখনের এবং পরিব্রাজকদের মতের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য পাওয়া যায়।
গৌড় রাষ্ট্রের স্থান নির্ণয় করতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই মৌখরি রাজা ইশানবর্মন গৌড় জয় করার সময় গৌড়ীয়দের সমুদ্রে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেন, এর থেকে আমরা অনুমান করতে পারি গৌড় রাষ্ট্র দক্ষিনে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।আবার সমসাময়িক লেখন বরাহমিহিরের বিরাট সংহিতাতে আমরা গৌড়ের সাথে সমতট, তাম্রলিপ্তি, পৌণ্ড্র রাজ্যের নাম এক সাথে পাই। কিছু কিছু জায়গাতে আমরা আবার বঙ্গ এবং গৌড়ের নাম একসাথে উল্লেখ পাই। ভবিষ্যপুরানে আমরা গৌড়কে দেখতে পাই বর্তমান বর্ধমানের উত্তরে এবং পদ্মা নদীর দক্ষিনে।
ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী বঙ্গ রাষ্ট্রের সীমানা আর্য সভ্যতার বাইরে ছিল। কালিদাসের কাব্যে বঙ্গ রাষ্ট্রকে গঙ্গার অববাহিকাতে বলা হয়েছে। কিছু জৈন শাস্ত্র অনুযায়ী ভাগীরথির পশ্চিম পারের তাম্রলিপ্তি (বর্তমান তমলুক) বঙ্গ রাষ্ট্রের অন্তর্গত ছিল যদিও কিছু কিছু জায়গাতে তাম্রলিপ্তিকে এক আলাদা রাষ্ট্র বলা হয়েছে। কিন্তু বঙ্গ রাষ্ট্রের শাসন সাধারণত গঙ্গার পুর্ব দিকেই ছিল। খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে উপবঙ্গ এলাকা বিস্তার যশহর পর্যন্ত বলে দিগ্বিজয়-প্রকাশেবলা হয়েছে। কারুর মতে বঙ্গ রাষ্ট্রের বিস্তার শ্রীহট্ট জেলা পর্যন্ত ছিল।
হুয়েনসাং এর বর্ণনা অনুযায়ী সমতটের স্থান আমরা পাই কামরূপের (আসামের) দক্ষিনে এক নাবাল জমির এলাকা যেটা সমূদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর রাজধানী ছিল কার্মান্তা তে (বর্তমান বাংলাদেসের কুমিল্লা জেলায়)। এর থেকে অনুমান করা হচ্ছে সে সমতট রাষ্ট্র ছিল বাংলা দেশের কুমিল্লার টিপেরা
হরিকেলার স্থান নির্ণয় করা একটু মুশকিলের। যাদব-প্রকাশ গ্রন্থে হরিকেলী এবং বঙ্গ দুটোকে এক সাথে বলা হয়েছে , আবার মঞ্জুরী-মূলকল্প তে গৌড়, বঙ্গ এবং হরিকেলা আলাদা ভাবে বলে হয়েছে। কিছু চৈনিক পরিব্রাজকদের মতে হরিকেলার স্থান বলা হয়েছে সমতট এবং উড়িশ্যার মধ্যে উপকূলবর্তী অঞ্চল। আবার কীর্তিসারের রুদ্রাক্ষ মাহাত্ম তে আমার পাই যে হরিকেলা শ্রীহট্ট দেশে। রূপচিন্তামণি লেখনের হিসাবেও হরিকেলা র স্থান ছিল বর্তমান শ্রীহট্ট জেলার অঞ্চল।অতএব আমরা ধরে নিতে পারি যে বর্তমান বাংলা দেশের শ্রীহট্ট এবং আসামের কাছাড় এলাকাতে হরিকেলা রাষ্ট্র ছিল।
এই সাথে আমরা আর একটি নাম পাই চন্দ্রদ্বীপ। ডক্টর পি সি বাগচীর মতে বাংলা দেশের সমস্ত উপকুল এলাকার দ্বীপসমুহকে (সন্দীপ সমেত) চন্দ্রদ্বীপ বলা হত।
আরও দুটি নাম আমরা পাই পুন্ড্র বা পৌণ্ড্র এবং বারেন্দ্র। পুন্ড্র রাষ্ট্রের অবস্থান সম্বন্ধে বলা হচ্ছে এটি কোশি নদীর তীরে অবস্থিত। এখানে এটুকু বলে নেওয়া দরকার যে কোশী আগে গঙ্গার উপনদীর বদলে ব্রহ্মপুত্রর উপনদী ছিল। অর্থাৎ কোশী উত্তর বঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত হত। ক্রমশ এই নদী পশ্চিমদিকে সরে গেছে এবং একন গাঙ্গার সাথে গিয়ে বিহারে মিলিত হয়েছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে পুন্ড্র বা পৌণ্ড্র বা পৌন্ড্রবর্ধন রাষ্ট্র উত্তর বঙ্গে গঙ্গা এবং করতোয়া নদীর মাঝখানে ছিল। বারেন্দ্রভূমি বা বারেব্দ্র রাষ্ট্র সম্বন্ধে আমরা একে পৌণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্গত পাই কিন্তু আবার একে পুর্ব বাংলার বগুড়া, রাজসাহী এবং ফরিদপুর জেলা জুড়ে অবস্থিত দেখি।
তাম্রলিপ্তির উল্লেখ আমরা মহাভারতের সভাপর্বে পাই যেখানে একে বাংলা এবং সুমা রাষ্ট্রের থেকে আলাদা করে উল্লেখ করা হচ্ছে। আবার পরে একে আমরা বঙ্গ এবং সুমার অন্তর্গত অবস্থাতে পাই। এর স্থান আমরা পাই মেদিনীপুর জেলার উপকূলবর্তী অঞ্চলে। রাজধানী তাম্রলিপ্ত বা তমলুক ছিল।
এবার আমরা পাচ্ছি একটি রাষ্ট্রের নাম বেঙ্গল বা বেঙ্গালা বা বাঙ্গালা। রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় গোবিন্দের সময় থেকেই এই রাষ্ট্রটি বঙ্গ রাষ্ট্রের সাথে উল্লিখিত হয়েছে। এটা মনে করা হয় পর্তুগীজ নাম বেঙ্গালা বা ইংরাজী নাম বেঙ্গল এই বেঙ্গালা রাষ্ট্রের থেকেই এসেছে।এটাও হতে পারে যে বঙ্গ রাষ্ট্রের থেকে উদ্ভব হয়ে উপবঙ্গ, পরে বেঙ্গালা হয়েছিল। ময়নামতী কাব্যে গোপীচাদে বাঙ্গালার লোকেদের সম্বন্ধে বলা হচ্ছে তাদের লম্বা দাড়ি আছে এবং তারা ভাটীর দেশ থেকে এসেছে। ভাটী বলতে আমরা নদীর ভাটী এলাকা বুঝি এবং তিব্বতীয় লামা তারানাথের মত অনুযায়ী ভাটী হচ্ছে গঙ্গার মোহানার নীচু অঞ্চল, মুলতঃ খুলনা এবং বরিশাল জেলার সুন্দরবন এলাকা। আবুল ফজলের লেখাতে আমরা যে আলের উল্লেখ পাই সেই আল দিয়ে সমূদ্রের জল আটকানো এখনও সুন্দরবন এলাকাতে হয়।
এই খানে একটা কথা বলে নিই, পশ্চিমবঙ্গের লোকে যে পুর্ব বঙ্গের অধিবাসীদের বাঙ্গাল নামে অভিহিত করে সেটার উৎপত্তি খুব সম্ভবত এই বাঙ্গালা দেশের বাঙ্গাল নামের অধিবাসী থেকে।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পরে রাজা হিসাবে আমরা পাই রাজা শশাঙ্কের নাম। রাজা শশাঙ্ক আবার তার রাজত্বকালে গৌড় এর সাথে বঙ্গ এবং সমতটকে এক করেন। রাজধানী হয় কর্ণ সুবর্ণ । কনৌজের রাজা হর্ষবর্ধনের বোন রাজ্যশ্রীর স্বামী গ্রহবর্মনকে মালবার রাজা হত্যা করলে রাজ্যশ্রী বন্দী হন। রাজ্যবর্ধন তাঁকে উদ্ধার করতে গিয়ে শশাঙ্কের হাতে নিহত হন। শশাঙ্কের অধীনে কনৌজ আসে। হর্ষবর্ধন শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেন এবং কনৌজ দখল করেন। এই সময় কামরুপের রাজা, শশাকের ভয়ে ভীত হয়ে হর্ষবর্ধনের সাথে সন্ধি করে শশাঙ্ককে আক্রমণ করেন। রাজা শশাঙ্ক সোজা যুদ্ধে না গিয়ে তার সৈন্যদল নিয়ে পেছনে সরে আসেন।
রাজা শশাঙ্কের পরাক্রম সম্বন্ধে বলা হয় যে তার সাম্রাজ্য উড়িষ্যা পার হয়ে বর্তমান অন্ধ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে হর্ষবর্ধন তার রাজ্য দখল করেন যদিও এটা মানা হয় যে পদ্মানদীর পুর্ব এবং দক্ষিণ অঞ্চলে হর্ষবর্ধনের কোন প্রতিপত্তি ছিল না। হর্ষবর্ধনের সাথে পুলকেশি দ্বিতীয়ের যুদ্ধের পরে হর্ষবর্ধনের রাজ্য দুভাগ হয়ে যায় এবং তার কিছুদিন পরে হর্ষবর্ধনের মৃত্যু হলে বাংলা দেশে বৌদ্ধ ধর্ম এবং ব্রাহ্মন্যবাদের মধ্যে বিবাদ প্রকট হয়।
শশাঙ্কের নৃত্যুর পরে আমরা গৌড়ে এক জয়নাগ রাজার নাম পাই। তার বংশের বিস্তারিত কিছু না জানা গেলেও তিনি মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহন করে কর্ণ সুবর্ন জয় করে রাজ্যের বিস্তার করেন। রাজ্যের সীমা সম্বন্ধে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে বঙ্গ দেশ বা বর্তমান পুর্ববঙ্গে কিছু ব্রাহ্মণ রাজাদের শাসনের খবর পাওয়া যায়। শীলভদ্র এই রকম এক ব্রাহ্মণ রাজবংশের ছিলেন, কিন্তু তাদের উপর হিমালয়ের এলাকার এক শৈল বংশীয় রাজার আক্রমনের কথা জানা যায়। যশোবর্মন খৃষ্টীয় ৭২৫ থেকে ৭৩৫ পর্যন্ত গৌড়ের শাসন করার পরে গৌড় কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্যের অধীনে চলে আসে।এই সময়ে কয়েকজন সামন্ত রাজার নাম আমরা পাই যারা বঙ্গ দেশে শাসন করছিলেন যেমন জীবধরণ, এবং শ্রীধরণ। এদের সাথে লোকনাথ এবং জয়াতুঙ্গবর্ষ এদের দুজনের নাম পাওয়া যায়, কাজেই মনে হয় সমস্ত রাজ্যের শাসন কারুর একার হাতে না থেকে ছোট ছোট এলাকার শাসন এরা করছিলেন।
সপ্তম শতাব্দী মধ্যভাগ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত এক তিব্বতীয় বর্ণনা অনুযায়ী এক চন্দ্র বংশ বঙ্গ দেশে শাসন করছিলেন, তাদের দুজনের নাম আমরা পেয়েছি, গোবিন্দচন্দ্র এবং ললিতচন্দ্র। মোটামুটি ভাবে বলা যায় শশাঙ্কের নৃত্যুর পরে গৌড় এবং বঙ্গদেশের শাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছিল এবং ছোট ছোট সামন্তের শাসন চলছিল বা বহিরাগতদের আক্রমণ হচ্ছিল।
খৃষ্টীয় ৭৫০ সালে গোপাল প্রথম নির্বাচিত প্রধান হিসাবে বৌদ্ধ রাজতন্ত্রের বা পাল বংশের পত্তন করেন। তার পরে ধর্মপাল এবং দেবপালের সময় পাল বংশের রাজ্যের বিস্তার ঘটে। ধর্মপালের সময় বর্তমান বাংলা এবং বিহার তার নিজের শাসনে ছিল, কনৌজে তার আশ্রিত চক্রায়ুধ শাসন করছিলেন। তার পশ্চিমে রাজপুতানা এবং পাঞ্জাবে ধর্মপালের আশ্রিত রাজাদের শাসন ছিল, উত্তরে তার অধীনে নেপাল এসেছিল।
প্রতিহার রাজা নাগভাট দ্বিতীয়ের সাথে যুদ্ধে ধর্মপাল পরাজিত হলে রাষ্ট্রকূট রাজা তৃতীয় গোবিন্দের সহায়তায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান, ফলে ধর্মপাল গোবিন্দ তৃতীয়ের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। কিছুদিনের মধ্যে গোবিন্দ আবার ধর্মপালকে তার রাজ্য ফেরত দিয়ে দক্ষিনাত্যে ফিরে যান।
ধর্মপালের মৃত্যুর পরে তার পুত্র দেবপাল রাজা হন। দেবপালের সনয় গৌড়ের পাল বংশের রাজ্যসীমা পশ্চিমে আফগানিস্থান, পুর্বে প্রাগজ্যোতিষ এবং দক্ষিণে উতকল পার হয়ে দ্রাবিড় অঞ্চল। দেবপালের মৃত্যুর পরে কিছুদিন পাল বংশের গরিমা স্থিমিত হয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা চারা দ্যায়।
পরবর্তী রাজা প্রথম মহীপাল আবার পাল বংশের রাজ্যের টুকরোগুলিকে একত্রিত করেন, কিন্তু মহীপালের মৃত্যুর পরে আবার পাল রাজ্যের অবনতি শুরু হয় পরে রাজা রামপাল এসে আবার পাল বংশের গরিমার পুনরুদ্ধার করেন।
উতকলের গঙ্গা বংশের রাজা অনঙ্গ ভীমদেবের কাছে রামপালের পরাজয়ের পরে গঙ্গা বংশের রাজ্যের সীমা হুগলী নদী পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। পাল রাজতন্ত্রের অবনতি হতে থাকে। বর্তমান বাংলা ভাষার আদিম কাব্য চর্যাপদের রচনা এই পাল বংশের সময়ে।
পাল বংশের রাজত্বের সময় আমরা জিমুতবাহনের নাম পাই যিনি ধর্মশাস্ত্রে দায়ভাগ এবং স্ত্রীধনের প্রণয়ন করেন। জীমুতবাহনের অন্য দুটি গ্রন্থের এমটি হল বিচার ব্যবস্থা সম্বন্ধে ব্যবহারমাত্রিকা এবং অন্যটি হচ্ছে ধার্মিক আচার সঙ্ক্রান্ত গ্রন্থ কালবিবেক। দেবপালের মন্ত্রী দর্ভপানী এবং তার পুত্র পৌত্রদের বেদ, আগম , নীতি এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রে পারদর্শি বলে জানা যায়। রাজা ধর্মপালের সময়ে বারেন্দ্র ব্রাহ্মনেরা শ্রুতি, স্মৃতি, পুরান, ব্যাকরণ এবং কাব্যে পারদর্শী ছিলেন বলে জানা যায়।
সাহিত্যে সন্ধ্যাকারানন্দির লেখা রামচরিতমানসের উল্লেখ আমরা পাই যেখানে একদিকে রামায়নের বর্ননা করা হয়েছে আর অন্য দিকে তার সাথে রাজা রামপালের গুণকীর্তন করা হয়েছে।
চরক এবং শুশ্রুতের ব্যাখ্যাকার চক্রপাণিদত্ত এবং ভেষজশাস্ত্রে উদ্ভিদ সম্বন্ধীয় গ্রন্থ শব্দ-প্রদীপের লেখক সুরেশ্বর বা সুরপাল , এবং চিকিৎসা-সার-সংগ্রহের লেখক বঙ্গসেনা এই পাল রাজত্বের সময় ছিলেন।
রাজা ধর্মপালের সময় বাংলা ভাষার আদি রূপ “প্রোটো-বেঙ্গলী” র উদ্ভব হয় এবং এই ভাষাতেই বৌদ্ধ তান্ত্রিকেরা চর্যাপদের সৃষ্টি করেন।
যদিও সামন্তসেন বর্তমান বর্ধমান জেলায় রাধা রাষ্ট্র জয় করে তার রাজত্বের পত্তন করেন কিন্তু সামন্তসেনের পৌত্র বিজয়সেন আসল সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা। কর্ণাটক থেকে আগত চালুক্য রাজা তৃতীয় বিক্রমাদিত্যের সেনা দলের সামন্তসেন ব্রহ্ম-ক্ষত্রিয় বলে মনে করা হলেও তিনি ব্রাহ্মন ছিলেন, এবং তার উত্তরাধিকারীরা রাজধর্ম পালনের জন্য ব্রহ্ম-ক্ষত্রিয় বলে পরিচিত হন।
খৃষ্টিয় দ্বাদশ শতাব্দীতে বিজয় সেন, পাল বংশের রাজা মদন পালকে হারি্যে সেন বংশের গরিমার প্রতিষ্ঠা করেন। গৌড়, মিথিলা, কামরূপ এবং কলিঙ্গ জয় করে তার বিশাল সাম্রাজ্যের সৃষ্টি করেন। আবার বাংলা দেশে বৌদ্ধ ধর্মের অবনতি হতে থেকে এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের শক্তি মাথা চারা দ্যায়। রাজা বল্লাল সেন তার রাজধানী গৌড় থেকে তুলে নবদ্বীপে নিয়ে আসেন। তার রাজ্যের সীমানা সম্বন্ধে জানা যায় যে বঙ্গ, বারেন্দ্র, রাধা, বাগদী এবং মিথিলা তার রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। বর্তমান সুন্দরবন অঞ্চল ছিল বাগদীনামে এবং উত্তর বঙ্গ ছিল বারেন্দ্র নামে।।
বল্লালসেনের লিখিত দানসাগর এবং অদ্ভুতসাগর দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ। দানসাগর লেখা হয়েছিল দান দেবার কারণ, উপায়, সামগ্রী ইত্যাদি সম্বন্ধে এবং অদ্ভুতসাগর নানান সংস্কার এবং তার প্রতিকার সম্বন্ধে। দ্বিতীয় গ্রন্থটি লেখা বল্লালসেন শুরু করলেও শেষ করেন তার পুত্র লক্ষনসেন। বল্লাল সেন বাংলা দেশে বর্ণভেদ প্রথার প্রচলন করেন।
বল্লাল সেনের পুত্র রাজা লক্ষন সেনের সময় মহম্মদ ঘোরীর সেনাপতি বখতিয়ার খিলজীর আক্রমণ হলে লক্ষনসেন পালিয়ে ঢাকাতে চলে যান। ঢাকার বিক্রমপুর অঞ্চল (বর্তমান মুন্সীগঞ্জ) তার রাজধানী হয়। এই সেন বংশের সময় আবার সংস্কৃত ভাষার পুনঃপ্রসার ঘটে। লক্ষনসেন কে বাংলা বিক্রমাদিত্য বলা হয়। তার সভাতে গোবর্ধন, সারন, উমাপতি এবং কবিরাজ এবন জয়দেব পঞ্চরত্ন হিসাবে ছিলেন। গীত গোবিন্দ লেখক কবি জয়দেব রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি ছিলেন। লক্ষনসেনের মন্ত্রী হলায়ুধের লেখা ব্রহ্মণ্য-সর্বস্ব, মীমাংসা-সর্বস্ব, বৈষ্ণব-সর্বস্ব, শৈব-সর্বস্ব, এবং পন্ডিত-সর্বস্ব উল্লেখযোগ্য।এর মধ্যে একমাত্র ব্রহ্মন্য-সর্বস্ব ছাড়া বাকী গুলি কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। ব্রহ্মন্য-সর্বস্বতে বেদের মন্ত্রগুলি দৈনিক ব্যবহারের ব্যখ্যা করা হয়েছে।
সেন বংশের অস্তিত্ব খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মিলিয়ে যায়। যদিও আমরা পরে এক দেব বংশের কথা এই বিক্রমপুর অঞ্চলে পাই। এদের শাসন পুর্বদিকে চট্টগ্রাম থেকে পশ্চিমে কুমিল্লা অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দেব বংশের শেষ ইতিহাস কিছু পাওয়া যায় নি।
এর পরে বাংলা দেশে মুসলিম শাসনের কথা আসে। সেটা পরে লিখছি।
No comments:
Post a Comment