গঙ্গা ভারতবর্ষের এক প্রধান নদী, সুদূর হিমালয় থেকে বেরিয়ে উত্তরাখন্ড, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খন্ড, পশ্চিম বঙ্গ হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। দৃষ্টিগোচর ভাবে গোমুখে এর উৎপত্তি আর সাগর দ্বীপের কাছে এর অন্ত। ভারতের এই প্রধান নদী নিয়ে অনেক পৌরাণিক কথা প্রচলিত আছে। গঙ্গাকে মনে করা হয় পাবন সলিলা, এর জলে সব পাপ ধুয়ে যায়।
একটিমতে গঙ্গা, লক্ষী আর সরস্বতী তিনজনে ছিলেন বিষ্ণুর স্ত্রী। তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে থাকতেন। বিরক্ত হয়ে বিষ্ণু তাদের আলাদা করে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। নিজে লক্ষীকে রাখেন, গঙ্গা যায় শিবের ভাগ্যে আর সরস্বতী যায় ব্রহ্মার ভাগ্যে।
অন্যমতে বিষ্ণু বামন অবতার হিসাবে অসুরদের রাজা মহাবলির যজ্ঞস্থলে যান। পৃথিবীর মাপ নেবার জন্য তাঁর বাঁ পা বাড়িয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে যখন দেখছিলেন যে কোথায় মর্ত্য শেষ হয়েছে, তখন ত্রিলোকের উপরে যে আবরণ ছিল সেটাতে ফুটো হয়ে যায় আর ব্রহ্মসাগরের জল উপচে উপরে উঠে আসে। এই জলধারাই হচ্ছে গঙ্গা। বলা হয় ভগীরথের অনুরধে গঙ্গার মর্ত্যে অবতরণ হয়।
কিন্তু কেন তিনি মর্ত্যে এলেন। এই সম্বন্ধে দুটি কথার প্রচলন আছে। প্রথমটি রাজা শান্তণু কে নিয়ে আর দ্বিতীয়টি সাগরের বংশধর ভগীরথ কে নিয়ে। আমরা প্রথমে ভগীরথের কাহিনী দেখি।
রাজা সাগর ঠিক করলেন যে তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন। নিয়ম অনুযায়ী ঘোড়া ছেড়ে দেওয়া হল। সব যায়গা থেকে ঘোড়া বশ্যতা স্বীকার করিয়ে ফিরে এল। এবার ঘোড়া চলে গেছে পাতাল পুরীতে। আর ফেরেনা।
সাগর রাজার ষাট হাজার ছেলে ঘোড়া খুজতে খুজতে পাতালে গিয়ে দেখে মহামুনি কপিল বসে ধ্যান করছেন আর তাঁর পাশেই অশ্বমেধের ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেরা রেগে গিয়ে কপিল মুনিকে গালি গালাজ করাতে, কপিল মুনি ধ্যান ভঙ্গ হবার রাগে একবার এই ষাট হাজার ছেলের দিকে তাকান আর তারা পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
কালক্রমে এদের বংশধর রাজা দিলীপের পুত্র ভগীরথ দেখে তাঁর ঐ ষাট হাজার পুর্বপুরুষ পারলৌকিক ক্রিয়া হয়নি বলে ভুত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভগীরথ ঠিক করে সে এদের উদ্ধার করবে।
ভগীরথ চলে যায় ব্রহ্মার কাছে। বলে যদি গঙ্গার জলধারা দিয়ে তাদের পুর্বপুরুষের ভস্মকে ধোয়া যায় তবে তারা মুক্তি পাবে। অতএব হে ব্রহ্মা, দয়া করে গঙ্গাকে মর্ত্যে আসতে বলুন।
নানান স্তব স্তুতির পরে ব্রহ্মা প্রসন্ন হয়ে গঙ্গাকে বললেন, যাও তুমি, মর্ত্য হয়ে পাতালে গিয়ে এদের উদ্ধার কর। ভগীরথ খুসি হয়ে গঙ্গাকে বলে সোজা পাতালে গেলেই তারাতাড়ি হবে। গঙ্গা ভাবে তাকে পাতালে যেতে বলে অপমান করা হচ্ছে। সে পুর্ণ বেগে মর্ত্যে নামার জন্য তৈরি হয়।
গঙ্গার এই পুর্ণ বেগ যদি পৃথিবীতে সোজা নামত, তবে সমস্ত পৃথিবী ধংস হয়ে যেত, তাই ভগীরথ গিয়ে শিবের শরণাপন্ন হয়। শিব গঙ্গাকে বলে, প্রথমে তুমি আমার মাথার উপরে নাম, তার পরে সেখান থেকে মর্তে নামবে। গঙ্গা তাই করে আর নামামাত্রই শিব তাঁর চুল দিয়ে জটা বানিয়ে গঙ্গাকে তাতে আটকে ফেলে। তাঁর পরে অল্প অল্প করে ছাড়তে থাকে। পৃথিবী ধংসের হাত থেকে বেঁচে যায়।
ভগীরথ গঙ্গাকে রাস্তা দেখিয়ে পাতাল পূরীতে নিয়ে গিয়ে তাঁর পূর্বপুরুষদের উদ্ধার করেন। মকর সংক্রান্তির দিন এই পুর্বপুরুষের উদ্ধারের স্মৃতি নিয়ে গঙ্গাসাগর স্নান হয়।
দ্বিতীয় কাহিনীটি রাজা শান্তনুকে নিয়ে। ইক্ষাকু বংশের রাজা মহাভিষ তাঁর নিজের পুন্যের ফলে স্বর্গে গিয়েছিলেন। একদিন যখন ব্রহ্মা ধ্যান করছেন আর সবাই সামনে বসে আছেন তখন গঙ্গা ব্রহ্মার সাথে দেখা করতে আসেন। খুব জোরে বাতাস বইছিল আর সেই কারনে গঙ্গার কাপড় অস্তব্যস্ত হয়ে দেহশোভা দেখা যাচ্ছিল।
সবাই লজ্জায় মাটির দিকে তাকিয়ে থাকেন কিন্তু রাজা মহাভিষ গঙ্গার দিকে নির্নিমেশ তাকিয়ে তাকে দেখতে থাকেন। মহাভিষ দেখতে অপূর্ন সুন্দর ছিলেন তাই গঙ্গাও তাঁর দিকে চেয়ে থাকেন। তাদের দুজনে এই আচরণ স্বর্গের স্বাভাবিক আচরণ বলে গন্য না হওয়াতে দুজনকে অভিশাপ দেওয়া হয় যে তাঁর মর্ত্যে জন্মাবেন আর একে অপরকে বিবাহ করবেন।
মহাভিষ মর্ত্যে প্রতীপের পুত্র শান্তনূ হিসাবে জন্মান। ওদিকে গঙ্গা ফিরে আসার সময় রাস্তাতে অষ্টবসুদের সাথে দেখা হয়। বশিষ্ট মুনির সুরভী গাই চুরি করার জন্য তাদের বশিষ্ট শাপ দেন সে তারা মর্ত্যলোকে জন্ম নেবেন। অষ্টবসু (আট জন বসু) শাপভয়ে গঙ্গাকে বলেন তুমি যদি আমাদের মাতা হও তবে আমরা সহজেই এর থেকে মুক্তি পেতে পারি। গঙ্গা নিজে এদের মুক্তির উপায় স্থির করে নিয়ে সম্মতি দেন।
এদিকে রাজা শান্তনু শিকারে গিয়ে গঙ্গার দেখা পান। গঙ্গাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলে গঙ্গা সম্মতি দ্যায়। কিন্তু এক সর্ত আরোপ করে। বলে যে গঙ্গা যাই করুক না কেন তাঁর কোন রকম প্রতিবাদ বা কারণ জিজ্ঞাসা করা চলবে না। যদি করেন তবে গঙ্গা তখনই শান্তণুকে ছেড়ে চলে যাবে।। শান্তনু রাজি হয়।
বিয়ে হয়ে যায়। দিন যায়। গঙ্গার প্রথম পুত্র হয়। শান্তনূ খুসী কিন্তু গঙ্গা তাঁর পুত্রকে নিয়ে নদীতে গিয়ে ভাসিয়ে দেয়। শান্তনু দু;খ পায় কিন্তু বিয়ের আগে গঙ্গাকে দেওয়া অঙ্গীকার মনে করে কিছু বলে না। এক এক করে পর পর সাত পুত্রকে এই ভাবে গঙ্গা জলে ভাসিয়ে দ্যায়।
যখন অষ্টম পুত্রকে নিয়ে গঙ্গা জলে ভাসাতে যাচ্ছে তখন শান্তনু আর থাকতে পারে না, সে গঙ্গাকে আটকায়। বলে তোমার মত নিষ্ঠুর মা আমি আর দেখিনি। এই ছেলে কে কেন ভাসিয়ে দেবে?।
গঙ্গা বলে আমার কাছে দেওয়া অঙ্গীকার তোমার নিশ্চয় মনে আছে। আমার কাজে তুমি বাধা দিয়েছে তাই আমি তোমায় ছেড়ে চললাম। এই ছেলেকে তুমি নাও ভাল করে মানুষ কর। বিরাট বীর আর ধার্মিক হবে।
এরা সব শাপ পেয়ে মর্ত্য লোকে জন্ম নেওয়া বসুগণ। এই সেই অষ্টম বসু যে সুরভিকে চুরি করেছিল তাই একে মর্ত্যলোকে থাকতে হবে আর বাকী সাতজন ছিল চুরির ব্যপারে সহযোগী মাত্র তাই তারা জন্ম নেবার পর তাদের মৃত্যু হয়েছে আর তাদের শাপের সময় তাতেই শেষ হয়ে গেছে,। এই বলে গঙ্গা অদৃশ্য হয়। শান্তনূ ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসে। এই ছেলের নাম দেবব্রত, যিনি পরে ভীষ্ম নামে পরিচিত হন।
Saturday, February 17, 2018
হিন্দু মাথোলজিঃ গঙ্গার কাহিনী
Tags
# হিন্দু মাথোলজি
About MSS Rehman
Templatesyard is a blogger resources site is a provider of high quality blogger template with premium looking layout and robust design. The main mission of templatesyard is to provide the best quality blogger templates which are professionally designed and perfectlly seo optimized to deliver best result for your blog.
হিন্দু মাথোলজি
Labels:
হিন্দু মাথোলজি
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment