বাংলার ইতিহাসঃ যশোর পত্তন - Human Timelines Myth & History

Hot

Post Top Ad

Saturday, February 17, 2018

বাংলার ইতিহাসঃ যশোর পত্তন

আজ থেকে ১০ লক্ষ বছর আগে হিমালয়ের শেষ পর্যায়ের উত্থান হয়েছিল বলে ভূতত্ত্ববিদেরা অনুমান করে আসছেন। মায়োসিন যুগের (গরপড়হব ঢ়বৎরড়ফ) পর এই উত্থানের ফলে বাংলাদেশের যেসব অঞ্চল গঠিত হয়েছিল, তার মধ্যে যশোর ভূ-ভাগ অন্যতম। হিমালয়ের এই শেষ পর্যায়ের উত্থানের যুগকে বলা হয়ে থাকে প্লায়েসটোসিন যুগ (চরবরংঃড়পবহব ঢ়বৎরড়ফ)।

উল্লেখ্যযোগ্য যে, হিমালয়ের উত্থানকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। দ্বিতীয় বার উত্থানের ফলে আসাম উপসাগরের তলানি তরঙ্গায়িত ভাঁজে পরিণত হয়ে গঠিত হয় বর্তমান আসামেন প্রাকৃতিক আকার। এই রূপে মায়োসিন যুগের শেষে আসাম উপসাগরের পশ্চিমাংশ- যথা, ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা ও সিলেট জেলার কতকাংশ সমন্বয়ে একটি বিরাট হ্রদে পরিণত হয়। ভারত মহাসাগর ও হ্রদের মাঝখানে বিরাজ করতো একটি ক্ষীণ বাঁধ। প্লায়েসটোসিন যুগে এই হ্রদ আর ভারত মহাসাগরের মধ্যবর্তী অংশটি অপসারিত হয়ে যায়। সমুদ্র তখন পদ্মা নদীর গতিপথ পর্যন্ত এসে পৌছেছিল। এই সময় গঙ্গা নদী ভারত উপদ্বীপ ও মধ্যভারতের পার্বত্য এলাকার মধ্যবর্তী এক গভীর খাতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতো। সম্ভবতঃ গঙ্গা নদী তৎকালে গোয়ালন্দের নিকটে বঙ্গোপসাগরে পতিত হতো। ক্রমান্বয়ে গঙ্গা নদীর পলি দ্বারা নতুন নতুন ভূভাগ গঠিত হতে থাকে। পরবর্তীতে এই ভূ-ভাগগুলি গাঙ্গেয় উপদ্বীপ বলে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রায় ২৫ হাজার বছর পূর্ব থেকেই নদীর মোহনায় এই সব ভূ-ভাগ গঠিত হয়ে আসছে। গঙ্গা নদীর পলি মাটিতে যশোর ভূ-খন্ডের যে সব দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছির, তার মধ্যে চক্রদ্বীপ বা চাকদাহ, এড়োদাহ বা এড়ো দ্বীপ, অন্ধ্র দ্বীপ, বৃদ্ধ দ্বীপ ও সূর্য দ্বীপ তাদের মধ্যে অন্যতম। ক্রমান্বয়ে এই দ্বীপগুলি রূপ নিয়েছিল বিশাল ভূ-খন্ডের। বর্তমানকালে এই সব দ্বীপগুলি পরিদর্শন করলে সহজেই এর আকার এবং প্রকৃতির পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দ্বীপ সৃষ্টি হবার প্রারম্ভিক যুগে বিশাল বন-জঙ্গলে ভরে উঠে স্থানটি। দ্বীপের বন-জঙ্গল কেটে ধীরে ধীরে মনুষ্য আবাস গড়ে উঠেছিল। ইদানীং কালের যে বিশাল সুন্দরবন, তা এক কালে যে যশোর ভূ-খন্ড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, তা সহজেই অনুমেয়। যশোর জেলার সদর মহকুমার বাগ আঁচড়া একটি প্রাচীন জনপদ। এই জনপদের একাংশের নাম আজও বাগ্ড়ী বলে পরিচিত হয়ে আসছে। এই স্থানটি প্রাচীন বৃদ্ধ দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। আমাদের ধারণা, এটিই হচ্ছে প্রাচীন বাগ্ড়ী। কানিংহাম গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ বাগ্ড়ী এবং সমতটকে একই রাজ্য বলে উল্লেখ্য করেছেন এবং এর রাজধানী মুরলী বা যশোর বলে অভিহিত করেছেন। তিনি চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের সমতটের চক্রাকৃতি ও এর বেষ্টনের পরিমাপ নিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। ইউয়েন সাঙ বর্ণিত গ্রন্থে আছে, সমতটের চক্রাকৃতি ও বেষ্টন ৩০০০ লী বা ৫০০ মাইল। রাজধানীর বেষ্টন ২০ লী বা সাড়ে তিন মাইল। কামরূপ ও তমলুক থেকে দূরত্ব মেপে তিনি মুরী বা যশোরকে রাজধানী বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। এক সময়ে পদ্মানদীর মধ্যবর্তী ভূ-খন্ড, ব্রহ্মপুত্র নদীর নিম্ন অংশ ও মেঘনার নিকটবর্তী স্থান বঙ্গ নামে অভিহিত করা হতো। পন্ডিত কালিদাস ও টলেমী গঙ্গারোজিয়া এই অঞ্চলটিকে বঙ্গ বলে উল্লেখ্য করেছেন। সমতট ছিল এর পূর্ব দিকে। ঐতিহ্যের আরণ্যক গ্রন্থে বঙ্গের নাম সর্বপ্রথম পরিলক্ষিত হয়। বৃহৎ সংহিতায় উপবঙ্গ নামে একটি জনপদের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘দ্বিগি¦জয় প্রকাশ’ নামক গ্রন্থে যশোর ও তৎসংলগ্ন কয়েকটি জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলকে উপবঙ্গ বলে উল্লেখ্য করা হয়েছে। বরাহ মিহিরের ‘বৃহৎ সংহিতায়’ ও একই কথা বিদ্যমান। এতে লিখিত আছে- “উপবঙ্গ যশোরদ্য দেশ ঃ কানন সংযুক্তা।” তৎকালে বঙ্গ, সমতট ও হরিকেল নামে তিনটি জনপদের পাশাপাশি অবস্থানের কথা পাওয়া যায়। আনুমানিক অষ্টম শতকে রচিত ‘আর্য মঞ্জুশ্রী মূল’ গ্রন্থে এই তিনটি জনপদের কথা লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু সামস সিরাজ আকিক রচিত “তারিখথ-ই-ফিরোজশাহী” গ্রন্থে যশোর অঞ্চলকে বলা হয়েছে ভাটি দেশ। অর্থাৎ অসংখ্য নদী-নালা পরিবেষ্টিত ছিল এই দেশটি। এই অঞ্চলে মনে হয় নদীতে নিয়মিত ভাটা হতো বলে ভাটি দেশ বলা হয়েছে। মানিক রাজার গানে ভাটি ও বাঙ্গাল শব্দ পাওয়া যায়। “ভাটি হইতে আইলা বাঙ্গাল লম্বা লম্বা দাড়ী।” ঐতিহাসিকেরা অনুমান করেছেন যে প্রকৃতপক্ষে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের পূর্বদিকের অঞ্চলই ছিল বঙ্গদেশ। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ বঙ্গের অন্তভুক্ত ছিল না। এর কিছু কিছু অংশ রাঢ়, বরেন্দ্রভূমি ও বাগ্ড়ীর অন্তর্গত ছিল। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের আকৃতি পূর্ব কালে এতো প্রশস্ত ও বিস্তৃত ছিল না। পানিনীর মহাভাস্য ‘পতঞ্জলী’ প্রাচীন আর্যাবর্তের সীমা নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছেন যে, এর পূর্ব ভাগে ছিল কালক বন। এই কালক বনই যে বর্তমান সুন্দরবন তা’ সহজে অনুমেয়। বৈদিক যুগে তিনটি দেশের নামের পরিচয় পাওয়া যায়। এই তিনটি দেশের নাম ছিল বঙ্গ, মগধ ও চের। তৎকালে এ দেশের অধিবাসীরা ছিল দুর্বল প্রকৃতির। তারা অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে জীবন ধারণ করতো। বঙ্গদেশে যে উপজাতির বসবাস ছিল তাদেরকে বলা হতো বঙ্গ। এ দেশের আবহাওয়া ও সমাজের সঙ্গে তারা এককভাবে মিশে যাবার ফলে আর্য ধর্মের প্রভাব ক্ষুণœ হয়। ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে বঙ্গের অধিবাসীদের বলা হয়েছে দাস্য। বাগ্ড়ীর অধিবাসীদের বলা হয়েছে ম্লেচ্ছ জাতি। এক সময়ে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের অধিবাসীরা বিরাট শৌর্য-বীর্যের অধিকারী ছিল। খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দিতে লিখিত গ্রীক ইতিহাস ‘চবৎরঢ়ষঁং ড়ভ ঃযব ঊৎুঃযৎবধহ ঝবধ’ তে গঙ্গা রিডিদের বীরত্বের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। গঙ্গা রিডিদের ৪০০০ যুদ্ধ হস্তী দেশ রক্ষা করবার জন্যে সর্বদা মোতায়েন রাখা হতো। গ্রীক দূত মেগাস্থিনিস চন্দ্রগুপ্তের সময় এদেশে আসেন। তার বিবরণীতে রাষ্ট্রকুট জাতির পরিচয় পাওয়া যায়। গঙ্গা রাঢ়ী শব্দের বিকৃত নাম গঙ্গা রিডি। গ্রীকদের উচ্চারণ দোষে গঙ্গা রিডি হয়েছে। এই রাষ্ট্রকুট জাতি এত প্রবল প্রতাপাম্বিত ছিল যে এদের হস্তী সৈন্যের ভয়ে এই রাজ্য অন্য রাজ্যের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেত। ডিওডোরাস বলেছেন, গঙ্গা রিডি ও অন্যান্য প্রতিবেশী রাজারা মহাবীর আলেকজান্ডারের আক্রমণ প্রতিরোধের জন্যে (খৃঃ পূঃ ৩২৫-২৭) ২০০০০০০ অশ্ব, ৮০০০০ পদাতিক, ৮০০০ সজ্জিত যুদ্ধরথ এবং ৬০০০ হস্তী মোতায়েন করেছিলেন। মহাবীর আলেকজান্ডার এদের শক্তিমত্তা ও ধন-ঐশ্বর্যের পরিচয় পেয়ে গঙ্গা তীর হতে প্রস্থান করেন। এই গঙ্গা রিডিদের রাজধানী ছিল বারোবাজার। খৃঃ পূঃ প্রথম শতাব্দীতে মহাকবি ভার্জিল তার ‘জার্জিকাস’ নামক কাব্য গ্রন্থে লিখেছেন, তিনি জন্মভূমি মন্টুয়া নগরীতে প্রত্যাবর্তন করে একটি মর্মর মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন। এই মন্দিরের শীর্ষদেশে স্বর্ণ ও গজদন্তে গঙ্গা রিডিদিগের বীরত্বেও কথা খোদিত রাখবেন। খৃঃ পূঃ ষষ্ঠ শতাব্দীতে বুদ্ধদেবের আবির্ভাব হয়েছিল। তিনি যে ধর্ম প্রচার করেন, তার নাম বৌদ্ধ ধর্ম। গয়ার নিকট বিরঞ্জনা নদী-তীরে সিদ্ধিলাভ করার পর চারদিকে তিনি আপন ধর্মমত প্রচার করতে শুরু করেন। তার ধর্ম প্রচারের বিস্তৃত ঘটে প্রথমে বিহারের পাটলীপুত্র ও নালান্দা অঞ্চলে। হিউয়েন সাঙের বিবরণীতে দেখা যায় বুদ্ধদেব বাংলাদেশেও আগমন করেছিলেন। তার ধর্মমত যশোর ভূ-খন্ডের উপরেও প্রভাব বিস্তার করে। বর্তমানে যশোর জেলার বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধদের মঠের খবর পাওয়া যায়। যশোরের সদর মহকুমার গদখালীতে এখনো অবধি মঠবাড়ি বলে একটি গ্রাম আছে। কোতোয়ালী থানার অন্তর্গত আলমনগর ও ফরিদপুরের নিকট মঠবাড়ি গ্রামটি বৌদ্ধদের একটি প্রাচীন স্থান। কালের গর্ভে বৌদ্ধদের স্মৃতি এখান থেকে বিনষ্ট হয়ে গেছে। গঙ্গা রিডিদের প্রাচীন রাজধানী বারোবাজারে বৌদ্ধ আমলের অনেক প্রাচীন নিদর্শনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এখানকার বৌদ্ধ মঠগুলি ভগ্ন¯তূপে পরিণত হয়েছে। এই সব ভগ্ন¯তূপগুলির পরিমাপ নিয়ে দেখা গেছে যে এগুলি ১০/১২ ফুট থেকে ১৫/১৬ ফুট উচ্চ। এই ¯তূপের মধ্য থেকে অনেক পুরাতন ইট ও প্রস্তও এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এখানকার প্রস্তরের কারুকার্য দেখে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে, এগুলি বৌদ্ধ যুগের। ভরত ডায়না গ্রামে ৭০ ফুট উঁচু গোলাকৃতি একটি প্রকান্ড ইষ্টক¯তূপ পরিদৃষ্ট হয়। এর পরিধি ৯০০ ফুটেরও অধিক। স্থানীয় প্রবাদে জানা যায় যে, এই ¯তূপটি নাকি জনৈক ভরত রাজার দেউল। নিকটবর্তী গৌরিঘোনা গ্রামেও এইরূপ একটি ¯তূপ দেখা যায়। প্রতœতত্ত্ববিদগণ অনুমান করেছেন যে, এগুলি প্রাচীন বৌদ্ধ ¯তূপের ধ্বংস¯তূপ । হিউয়েন সাঙ বর্ণনা করেছেন, এসব অঞ্চলে ত্রিশটি বৌদ্ধ সংঘারাম ছিল। সুতরাং এ সকল অঞ্চলে তৎকালে এ ধরনের বৌদ্ধ বিহার ও সংঘারাম থাকা বিচিত্র কিছু নয়। আগ্রো গ্রামে ৩টি ঢিবি বা ¯তূপ এখনো আছে। এই ঢিবি খুঁড়ে পুরাতন ইষ্টক নির্মিত বাটি পাওয়া গেছে। এই ধরণের ঢিবি দক্ষিণে চাঁদখালী ও উত্তরে টালা পর্যন্ত মাঝে মাঝে দেখা যায়। যশোর শহরের নিকটবর্তী মুরলীতেও বৌদ্ধ সংঘারাম ছিল। হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে দক্ষিণ বঙ্গের সুন্দরবন পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল। এই চৈনিক পরিব্রাজ হিউয়েন সাঙ হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে পাক-ভারতে পদার্পণ করেন। তিনি ছিলেন বৌদ্ধ ধর্ম্মাবলম্বী। বৌদ্ধ ধর্মের সমস্ত তীর্থভ্রমণ ও বৌদ্ধ দর্শন ও শাস্ত্র সংগ্রহ করা। এই কারণে তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত ইতিহাসবেত্তাদের কাছে মূল্যবান। বিম্বিসারের পুত্র অজাত শত্র“র রাজত্বকালে বুদ্ধদেব নির্বাণ লাভ করেন। অজাত শত্র“র পর শূদ্ররাজ মহানন্দ সিংহাসনে বসেন। আলেকজান্ডা মহানন্দের রাজত্বকালে ভারত বর্ষ আক্রমণ করেন। মহানন্দের পুত্র চন্দ্রগুপ্ত জৈন ধর্মের সমর্থক ছিলেন। চন্দ্রগুপ্তের পৌত্র অশোকের রাজত্বকালে বৌদ্ধ মূর্তি ও ¯তূপের সন্ধান পাওয়া গেছে, তা প্রায়ই মহারাজ অশোকের আমলে স্থাপিত। বৌদ্ধ বিহার ছিল ধর্ম প্রচারের কেন্দ্রস্থল। প্রথম পর্যায়ে এইসব বিহারগুলি ব্যবহৃত হতো বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের বর্ষাকালীন দুর্যোগের দিনে বসবাস করবার জন্যে। অশোকের মৃত্যুর পর পাক-ভারত নানা রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। খৃষ্ট পূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীতে মগধের গুপ্ত রাজ্যের পতন হয়। এই গুপ্ত বংশের রাজন্যবর্গেরা ছিলেন বৌদ্ধ বিদ্বেষী। তারা সমগ্র পাক-ভারতে হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু কৃষ্টি প্রতিষ্ঠা করার জন্যে তৎপর হন। পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু তার বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘এষরসঢ়ংবং ড়হ ডড়ৎষফ ঐরংঃড়ৎু’ তে লিখেছেন যে গুপ্ত সম্রাটদের আমলে হিন্দু সভ্যতার চরম উন্নতি সাধন হয়। এই সময় থেকে বৌদ্ধদের উৎখাত করা শুরু হয়েছিল। ক্ষত্রিয় ও উচ্চশ্রেণীর লোকেরা বৌদ্ধ ধর্ম নিশ্চিহ্ন থাকে। ক্রমান্বয়ে বৌদ্ধ বিহারগুলি হিন্দু রাজশক্তির প্রভাবে ধ্বং¯তূপে পরিণত হয়। কিছু কিছু বৌদ্ধ মঠ হিন্দুদের দেবালয়ে পরিণত হয়। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের বুড়ন দ্বীপের সোনাবেড়ে গ্রামে আজও অবধি একটি বিরাট মঠ শৈবদের দেবালয়ের পরিচয় বহন করে চলেছে। বারোবাজার, মুরলী প্রভৃতি স্থানের বৌদ্ধ বিহারগুলি সম্ভবতঃ একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়। শশাঙ্কের রাজত্বকালে হিন্দু ধর্মের অত্যাচারে অসংখ্য বৌদ্ধ হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। শশাঙ্ক ছিলেন শৈব মতাবলম্বী। তার মতো বৌদ্ধ বিদ্বেষরাজা ইতিহাসে বিরল। গুপ্ত যুগে যশোর ভূ-খন্ড গুপ্ত রাজগণের অধীনে আসে। সমুদ্র গুপ্তের সময় বাংলাদেশ গুপ্ত সাম্রাজের অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল। ব্রিটিশ আমলে যশোর জেলার উত্তরাঞ্চলের মধুমতী নদীর সান্নিকটে মোহাম্মদপুরে একটি পুকুর খনন করতে গিয়ে কয়েকটি প্রাচীন মুদ্র্রা আবিষ্কার হয়েছে। মুদ্রাগুলি গুপ্ত রাজবংশের চন্দ্রগুপ্ত, কুমার গুপ্ত ও স্ক›দ্ধ গুপ্তের প্রচলিত মুদ্রার ন্যায়। রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র বলেছেন, এই মুদ্রাগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে রাজা শশাঙ্কের, দ্বিতীয়টি কোন গুপ্ত নৃপতির এবং তৃতীয়টি সম্পর্কে কিছু জানা যায় নাই। এই মুদ্রাগুলি বর্তমান কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে রক্ষিত আছে। রাজশাহী জেলার দেবপাড়া গ্রামের প্রাপ্ত শিলালিপি প্রশাস্তি থেকে জানা যায় যে, বিজয় সেন গৌড়েশ্বরকে পরাজিত করে কামরূপ রাজ ও কলিঙ্গ রাজকে পরাজিত করেন। প্রায় ৩৫ বঝর কাল বিজয় সেন রাজত্ব করেন। তার মৃত্যুর পর গৌড় সিংহাসনে আরোহণ করেন তার পুত্র বল্লাল সেন। বল্লাল সেন খ্রষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে গৌড় সিংহাসনে উপবেশন করেন। বল্লাল সেনের মৃত্যুর পর তার পুত্র লক্ষ্মন সেন ১১১৩ খৃষ্টাব্দে গৌড়ের অধীশ্বর হন। বল্লাল সেনের রাজ্য পাঁচটি ভুক্তিতে বিভক্ত ছিল। বঙ্গ বা পূর্ববঙ্গ, বরেন্দ, মিথিলা, রাঢ় ও বাগড়ী। এর মধ্যে বাগড়ীর প্রাদেশিক রাজধানী ছিল যশোর জেলার সিঙ্গিয়া স্টেশন হতে প্রায় তিন মাইল পূর্বে ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত শেখ হাটি বা শাঁখ হাটি গ্রামে। কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন যে, সেন বংশীয় রাজা রক্ষ্মন সেন নবদ্বীপ পরিত্যাগ করে শেখ হাটিতে এসে বাস করেছিলেন। নিকটবর্তী দেওভোগ বা দেবভোগ প্রভৃতি গ্রাম প্রাচীন শেখ হাটির অন্তর্ভুক্ত ছিল। দেবভোগের এক অংশকে বিজয় তলা বলে। স্থানীয় প্রবাদ, এই স্থানে বল্লাল সেনের পিতা রাজা বিজয় সেনের বাড়ি ছিল। শেখ হাটিতে লক্ষ্মন সেনের প্রতিষ্ঠিত ভুবেনশ্বরী দেবীর একটি বিগ্রহ বিদ্যমান। এই প্রস্তও নির্মিত দেবী মূর্তি অতি সুন্দর। একটি অখন্ড কৃষ্ণ প্রস্তর কুঁদে মূর্তিটি নির্মিত। ভূবেনশ্বরী দেবীর পৌরাণিক ধ্যান অনুযায়ী পারিজাত কাননে কল্প বৃক্ষতলে মনিময় বেদীর উপর দেবী পদ্মাসনে উপবিষ্টা। দেবীর ছয়খানি হস্তে শঙ্খ, কমন্ডলু, অঙ্কুশ, পদ্ম, পুষ্পবান ও বরমুদ্রা বিরাজিত, গলে রত্মহার ও মস্তকে রতœমুকুট। শাঁখ হাটির এই প্রাচীন দেবী মূর্তিটি বাংলার ভাস্কর্য শিল্পের অতি অপূর্ব নিদর্শন। মূর্তিটি ৫ ফুট ও প্রস্থে ২-৫ ইঞ্চি। মহারাজ প্রতাপাদিত্যের অন্যতম সেনানায়ক কালিদাস রায় পুষ্করিণী খনন কালে মূর্তিটি পেয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠিত করেন। বল্লালে রাজত্বকালে লক্ষ্মণ সেন পূর্ববঙ্গে রাজ প্রতিনিধিরূপে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। বল্লালের একাধিক স্ত্রী ছিল। তিনি এক নীচ জাতীয় মহিলার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করেন। বল্লাল সেন পুত্রের এই আচরণের জন্য তাকে নির্বাসিত করেন। কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর একদিন বর্ষাকালে বল্লাল ভোজনের জন্যে অন্দর মহলে প্রবে করতে গিয়ে দেখতে পেলেন প্রাচীর গাত্রে একটি শ্লোক লিখিত আছে। এই শ্লোক ছিল তার বিরহী পুত্র বধূরই অন্তরবাণী। তিনি অনুশোচনা এবং অনুতাপ করতে লাগলেন। তখনই তিনি নাবিকদিগকে আহ্বান করে ঘোষণা করলেন যে, যদি কেহ পরের দিন সূর্যোদয়ের পূর্বে পুত্র লক্ষ্মণ সেনকে এনে দিতে সমর্থ হয়, তবে তাকে স্বীয় রাজ্যের একাংশ পুরষ্কার দেবেন। এই কার্যে কৃতকার্যতা লাভ করেছিল সূর্য মাঝি নামক জনৈক ধীবর। এই অসম্ভব কার্যের জন্যে রাজা তাকে একটি দ্বীপ দান করেন। এই দ্বীপ পরে সূর্যদ্বীপ নামে অভিহিত হয়। যশোরের মহেশপুরের অন্তর্গত আন্ধার কোটা গ্রামে সূর্য মাঝির রাজধানী ধ্বংসাবশেষ চিহ্ন আজও র্দৃষ্টিগোচর হয়। খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে মহম্মদ-ই-বখতিয়ার খিলজী সেন রাজগণের নিকট হতে গৌড় ও রাঢ় জয় করেন। মিনহাজ-উস-সিরাজ বর্ণিত ১১৯৪ খৃষ্টাব্দে মাত্র অষ্টাদশ অশ্বারোহীর সাহায্যে বখতিয়ার নদীয়া অধিকার করলে রাজা লক্ষ্মণ সেন নদীয়ার নবদ্বীপ থেকে পলায়ন করেন। সেন বংশের রাজত্বকালে নবদ্বীপ একটি নগরী হিসেবে পরিচিত ছিল। এখানে কোন শাসন কেন্দ্র ছিল কিনা তা’ ঐতিহাসিকেরা নির্ণয় করতে পারেন নাই। লক্ষ্মণ সেন তার রাজত্বের শেষ দিকে এখানে অবস্থান করতেন। সম্ভবতঃ মনে হয় নবদ্বীপ তৎকালে একটি তীর্থ ক্ষেত্র বলে পরিগণিত ছিল। রাজা মুসলমান অশ্বারোহীর অতর্কিত আক্রমণে দিশাহারা হয়ে সেখান থেকে পলায়নপূর্বক বাগড়ীর প্রাদেশিক রাজধানী শেখ হাটিতে এসে আশ্রয় নেন। নদীয়া ও যশোর পাশাপাশি অবস্থিত। নবদ্বীপ থেকে তার এখানে পালিয়ে আসা বিচিত্র কিছু নয়। কোন কোন ঐতিহাসিকেরা বলেন মুসলমানদের নবদ্বীপ অধিকারের সময় লক্ষ্মণ সেন জীবিত ছিলেন না। তার মৃত্যুর অর্দ্ধশতাব্দী পরে গৌড় রাজ মুগীসউদ্দিন য়ূজবক নদীয়া বিজয় করে সেই ঘটনা স্মরনার্থে নতুন মুদ্রা প্রবর্তন করেন। বখতিয়ার কর্তৃক নদীয়া বিজয়ের পর ১২৫ বছর পর কাল সেন বংশীয় রাজারা পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গের অধীশ্বর ছিলেন। মণ্ডী ও সুকেত রাজবংশের কুলপঞ্জিকা হতে জানা যায় যে লক্ষ্মণ সেনের বংশধর সুরসেন ১২৫৯ বিক্রমাব্দে মুসলমানগণ কর্তৃক গৌড় হতে বিতাড়িত হয়ে প্রয়াগে এসে বাস করেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র রূপ সেন পাঞ্জাবে গমন করে রূপর নামক স্থানে একটি রাজ্য স্থাপন করেন এবং ক্রমে ক্রমে মণ্ডী ও সুকেত এই রাজবংশের অধিকারে আসে। মহম্মদ-ই-বখতিয়ার খিলজি তিব্বত অভিযান হতে ফিরবার পথে দেবকোটে পরলোক গমন করলে তার সহকারীদের মধ্যে প্রথম আলি মর্দন ও পরে গিয়াসউদ্দিন দিল্লীর অধীনে গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ১২২১ খৃষ্টাব্দ হতে ১২২৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ইনি ঘাতক কর্তৃক নিহত হন। সম্রাট শামসউদ্দিন আলতাশের এক পুত্র নাসিরউদ্দিন গৌড়ের শাসনকর্তা ছিলেন। ১২৩৭ খ্রিষ্টাব্দের সুলতানা রাজিয়ার মুদ্রায় প্রথম লখনৌতি টাঁকশালেন নাম দৃষ্ট হয়। ১২৭৮ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীর সম্রাট গিয়াসউদ্দীন বলবনের সময়ে তুগ্রল খাঁ মুগীসউদ্দিন উপাধি গ্রহণ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তুর্ক-আফগান আমলের প্রথম দিকে যশোর ভূখণ্ডে মুসলমানেরা আগমন করেছিল-তার অনুসন্ধান পাওয়া যায়। বাগড়ীর উত্তরাংশ মুসলিম অধিকারে ছিল। কেহ কেহ অনুমান করেছেন যে, কেশব সেন বা অন্য কেহ এতদাঞ্চলে মুসলমানদের আড়ালে থেকে রাজ্য শাসন করতেন। মুসলমান অধিকারের পর উত্তরাঞ্চলের শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে চলেছিল। তবুও দেখা যায় দক্ষিণ বঙ্গে সে সময়ে অরাজকতা বিদ্যমান ছিল। ১৪৯৪ খৃষ্টাব্দে হাবসী রাজাদের অত্যাচারে প্রজারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে সুলতান শামসুদ্দিন মুজাফফর শাহকে নিহত করে রাজ্যের প্রধানগণ আলাউদ্দিস হুসেন শাহকে সুলতান নির্বাচিত করেন। ইনি আরবদেশ থেকে আগত ও সৈয়দ বংশীয় ছিলেন। আলাউদ্দিন হোসেন শাহের সহিত যশোর জেলা ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। তার কৈশোরের স্মৃতি বহন করছে বেনাপোলের কাগজ পুকুরিয়া গ্রাম। তিনি সেখানে এক ব্রাক্ষ্মণেন গৃহে আশ্রয় লাভ করেন। পরবর্তীকালে গৌড় বাংলার সিংহাসনে অধিকারী হন। ব্লকম্যান সুলতান যে, সুুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেই ফতেয়াবাদ থেকে স্বীয় নামে সর্বপ্রথম মুদ্রা প্রচলন করেন এবং সেখানেই স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করেন। তিনি এ সম্বন্ধে আরো উল্লেখ্য করেছেন যে, হোসেন শাহ তদীয় ভ্রাতা ইউসুফ শাহ এবং নিজ পুত্র নসরত ও মোহাম্মদ শাহের নামে যশোর, খুুলনা ও ফরিদপুরের নসরতশাহী, মোহাম্মদ শাহী ও ইউসুফ শাহী নামের পরগনা সৃষ্টি করেন। একখানি আরবি শিলালিপি থেকে জানা যায়, হোসেন শাহ ত্রিপুরা রাজের একাংশ দখল করেছিলন। সুন্দরবনের প্রান্তসীমা পর্যন্ত দক্ষিণে তার রাজ্য বিস্তৃত ছিল। হোসেন শাহের দুজন উজির ছিলেন যশোরেরই সন্তান-রূপ ও সনাতন। পরবর্তীকালে রূপ ও সনাতন বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা নিয়ে বৈষ্ণব জগতে অমর হয়ে আছেন। হোসেন শাহের মৃত্যুও পর তার পুত্র নসরত শাহ গৌড়ের সিংহাসনে বসেন। তিনি হোসেন শাহের জীবিত কালে মোহাম্মদাবাদ ও খলিফাতাবাদ থেকে স্বনামে স্বাধীন রাজার ন্যায় মুদ্রাঙ্কন করেন। মোহাম্মদাবাদ ও খলিফাতাবাদ বর্তমান যশোর ও খুলনা জেলায় অবস্থিত। এ সম্পর্কে ডক্টও তরফদার বলেছেন যে, জীবদ্দশায় হোসেন শাহ স্বীয় পুত্র নসরতকে খলিফাতাবাদ থেকে মুদ্রাঙ্কন করতে আদেশ দিয়েছিলেন। নসরত শাহের পরলোক গমনের পর তৎপুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিন মাস রাজত্ব করার পর তিনি হোসেন শাহের অন্যতম পুত্র গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ কর্তৃক নিহত হন। শের শাহ বঙ্গদেশ আক্রমণ করলে তিনি উপায়ান্তর না দেখে দক্ষিণ বঙ্গে পলায়ন করেন। তার দুই পুত্রত শের শাহের পুত্র জালাল খাঁর আদেশে নিহত হন। গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ এই খবর পেয়ে শোকে-দুঃখে ১৫৩৮ খৃষ্টাব্দে দেহত্যাগ করেন। আইন-ই-আকবরীতে লিখিত আছে যে শের শাহ মোহাম্মদাবাদ আক্রমণ করলে হোসেন বংশীয় জনৈক নৃপতি যশোরের উত্তর দিকে তার গতিরোধ করেন। তিনি যুদ্ধে পরাজিত হলে অনেকগুলি হস্তী ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। সে হস্তীগুলি পরবর্তীকালে বন্য হস্তীতে পরিণত হয়। হোসেন শাহী বংশের বহু কীর্তিরাজী যশোর জেলায় আজও পরিদৃষ্ট হয়। ঝিনাইদহ থেকে ১২ মাইল উত্তরে কুমার-নদীর তীরে শৈলকুপায় আজও একটি প্রাচীন মসজিদ ও মাজার আছে। এই মসজিদ নসরত শাহ কর্র্তৃক নির্মিত হয়েছিল। কথিত আছে, একদা নসরত শাহ গৌড় থেকে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে এই স্থানে অবস্থান। তার সংগে ছিলেন মাওলানা মোহাম্মদ আরব। তিনি ছিলেন খ্যাতনামা দরবেশ ও রাজ মুর্শেদ। মওলানা সাহেব এখানকার প্রাকৃতিক রূপ দেখে বিমোহিত হয়ে যান এবং এই স্থানেই বসতি স্থাপন করেন। মাওলানা সাহেবের কয়েকজন শিষ্য-হাকিম খাঁ, সৈয়দ শাহ, আব্দুল কাদের বাগদাদী ও একজন ফকিরও তার সংগে ছিলেন। সুলতান নসরত শাহ তাদের কিছু লাখোরাজ সম্পত্তি দান করেন। এই কারণে তার নামানুসারে এখানকার স্থানীয় মৌজার নাম হয় নাসিরপুর। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে ১৫৩৮-৩৯ খৃষ্টাব্দে হুমায়ুন গৌড় নগর অধিকার করেন। তিনি গৌড়ের “জন্নতাবাদ” বা স্বর্গপুরী এই নামকরণ করেন। শের শাহ গৌড়ের লুণ্ঠিত সম্পত্তি রোতাস দুর্গে স্থানান্তরিত করেন। গৌড়ে হুমায়ুন তিন মাস অবস্থান করবার পর তার সৈন্যাদি পীড়িত হয়ে পড়লে হুমায়ুন আগ্রার দিকে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে হুমায়ুন ছাপারঘাট নামক স্থানে শের শাহের হস্তে পরাজয় বরণ করেন। শের শাহ মগধ ও গৌড় রাজ্য পুনরায় অধিকার করে ফরিদউদ্দিন আবুল মোজাফফর শের শাহ নাম গ্রহণ করে গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। শের শাহের মৃত্যুর পর গৌড়ে তার শাসনকর্তা মহম্মদ খাঁ সুর ১৫৫২ খৃষ্টাব্দে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি ১৫৫৫ খৃষ্টাব্দে ছাপরামৌ এর যুদ্ধে হিমু কর্তৃক পরাজিত ও নিহত হলে তার পুত্র গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ গৌড়ের সুলতান হয়। এর কিছুকার পরে মগধের সুলতান সুলেমান কররাণী গৌড়ের অধিকারী হন। সুলেমান কররাণীর মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র বায়োজিদ নিজ নামে মুদ্রাঙ্কন করতে সাহস পান নাই। বায়োজিদের পর সুলেমান কররাণীর অপর পুত্র দায়ুদ শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। দায়ূদ শাহ আরবী ও হিন্দী ভাষায় নিজ নামে মুদ্রা বের করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব আরম্ভ করেন এবং পরে বহু সৈন্যাদি সংগ্রহ করে সম্রাট আকবরের রাজ্য আক্রমণ করেন। রাজা তোডর মল্ল ও খান খানান মুনমি খান তাকে দমন করতে আসেন। দায়ুদ ভীত হয়ে গৌড় পরিত্যাগ করেন। মুঘলবাহিনী তার পশ্চাদ কওে তাকে সপ্তগ্রাম থেকে হটিয়ে সুবর্ণরেখা নদীর নিকটে একরোই বা মুঘলমারি গ্রামে যুদ্ধ করতে বাধ্য করে। দায়ুদ পরাজিত হয়ে কটকে পলায়ন করেন। এই সময় ১৫৭৫ খৃষ্টাব্দে চারিদিকে অরাজকতা ও মহামারীতে গৌড় নগরী শ্মশানভূমিতে পরিণত হয়। এই বৎসরেই গৌড়ের শাসনকর্তা খান খানাম মুনীম খাঁ তাড়ায় দেহ ত্যাগ করলে দায়ুদ নিহ রাজ্য পুনরাধিকারের চেষ্টা করেন। রাজমহলের নিকট দায়ুদ ১৫৭৫খৃষ্টাব্দের ১২ই জুলাই মোঘল বাহিনীর নিকট পরাজিত ও বন্দী হন। তাকে হত্যা করে তার ছিন্ন মস্তক আকবরের নিকট পাঠানো হয়েছিল। সুলেমান কররাণী যখন গৌড়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তখন শিবনন্দ গুহ নামক জনৈক ব্যক্তি তার প্রধান কানুনগো ছিলেন। এই শিবানন্দের দুই ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রী হরি ও জানকী বল্লভ সুলেমানে পুত্র দায়ুদের সমবয়স্ক ও সহপাঠী ক্রীড়া সঙ্গী ছিলেন। দায়ুদ রাজ্য লাভ করবার পর শ্রী হরি ও জানকী বল্লভকে রাজস্ব বিভাগে অতি উচ্চপদে নিযুক্ত করে উভয়কে রাজ সম্মানে ভূষিত করেন। শ্রী হরি ও জানকী বল্লভকে দায়ুদ যথাক্রমে রাজা বিক্রমাদিত্য ও রাজা বসন্ত রায় উপাধি প্রধান করেন। এরা দুজনে খুড়তুতো ও জেঠতুতো ভাই ছিলেন। বসন্ত রায় সমস্ত বাংলাদেশের সম্পূর্ণ রাজস্বের হিসাব প্রস্তুত করে গৌড় দরবারে খ্যাতিলাভ করেন। কথিত আছে যে, তোডর মল্লের “আসল তুমার জমা” নামক বাংলার প্রসিদ্ধ রাজস্ব হিসাব বসন্ত রায়ের হিসাবের সাহায্যে প্রস্তুত হয়েছিল। এই সময় দক্ষিণ বঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চল বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় দায়ুদের নিকট থেকে বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন। গভীর অরণ্যের মধ্যে যমুনা নদীর তীরে যশোহর নামে একটি নগরের পত্তন করেন। মোঘলদের আক্রমণ ও অত্যাচার ভয়ে যখন গৌড়ের আমরি ওমরাহেরা ভীত ও সন্ত্রস্ত এবং রাজমহলের যুদ্ধে সম্রাট আকবরের ফৌজের হস্তে পরাজিত হয়ে দায়ুদ শাহ যখন সপ্তগ্রামে আশ্রয় গ্রহণের পর উড়িষ্যার দিকে পলায়ন করেন, তখন তিনি তার বিপুল অর্থরাশি রাজা বিক্রমাদিত্য ও রাজা বসন্ত রায়ের হাতে ন্যস্ত করেন। গৌড়ের এই চরম অরাজকতার দিনে বিক্রমাদিত্র ও বসন্ত রায় উদ্বেগাকুল হয়ে সুলতানের অপরিমিত ধনরতœ নৌকাযোগে যশোহরে প্রেরণ করেছিলেন। দায়ুদের পতনের পর উভয় ভ্রাতা সম্রাট আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেন এবং তার নিকট থেকে যশোহরে রাজ্যের সনদ প্রাপ্ত হন। প্রবাদ, গৌড়ের যশ হরণ করে এই শহরের শ্রীবৃদ্ধি হওয়ায় এর স্থানীয় পুরাতন নাম যশোর পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ হয় যশোহর। কথিত আছে যে, এই নামকরণ বসন্ত রায় করেছিলেন। নামে বিক্রমাদিত্য রাজা হলেও প্রকৃতপক্ষে বসন্ত রায়ই রাজ্যের সর্বসেরা ছিলেন। দুই ভ্রাতার মধ্যে ছিল গভীর সৌহার্দ। বসন্ত রায় বঙ্গের বিভিন্ন স্থান থেকে বহু আত্মীয়-স্বজনকে যশোহরে এনে বিরাট জনপদের সৃষ্টি করেন। সেই সময়ে এখানে গড়ে উঠেছিল ‘যশোর সমাজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। যশোহর রাজ্যেও সহিত প্রতিবেশী রাজাদের মধুর সম্পর্ক ছিল। বসন্ত রায়ের চেষ্টায় রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন স্থানে মন্দির প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ইতিহাসখ্যাত প্রতাপাদিত্য রাজা বিক্রমাদিত্যের পুত্র। অনেকেই অনুমান করেছেন, ১৫৬০/৬১ খৃষ্টাব্দে গৌড় নগরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকেই প্রতাপ বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্যে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। কথিত আছে যে, প্রতাটের কোষ্টি গগনা করে জ্যোতিষীরা বলেছিলেন যে তিনি পিতৃদ্রোহী হবেন। এই জন্যে রাজা বিক্রমাদিত্র প্রতাপে দূরে সরিয়ে রাখবার জন্যে আগ্রায় বাদশাহের দরবারে প্রেরণ করেছিলেন। প্রতাপাদিত্য বাদশাহ আকবরের সুনজরে পড়েন। আগ্রা থেকে যশোহরে প্রত্যাবর্তন করবার সময় পিতা ও পিতৃব্য বর্তমান থাকা সত্ত্বেও যশোহর রাজ্যেও সনদ নিজ নামে নিয়ে আসেন। যশোহর নগরের ৮/১০ মাইল দক্ষিণে যমুনা নদী ও ইছামতি নদীর সঙ্গম স্থলে ধূমঘাট নামক স্থানে এক নতুন নগরী প্রতিষ্ঠা করে তথায় প্রতাপাদিত্যের রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন করেন। ধূমঘাটের ধ্বংসাবশেষ বর্তমান তীরকাটি জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত। ধূমঘাটের দুর্গ নির্মাণের প্রধান ভার ছিল তার বিশ্বস্ত পাঠান সেনাপতি কমল খোজার উপর। রাজদন্ড গ্রহণ করে প্রতাপাদিত্য বঙ্গোপসাগরের উপকূল ভাগে মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের অত্যাচার দমনে মনোনিবেশ করেন। দক্ষিণ বঙ্গ তখন জলদস্যুদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তারা বহু স্ত্রী-পুরুষ ধরে নিয়ে ক্রীতদাস রূপে নিয়োজিত করতো এবং গোলন্দাজ, ফরাসী ও ইংরেজ বণিকদের নিকট বিক্রয় করতো। স্থল হতে বন্দীদিগকে ধরে নিয়ে হাতের তালুতে ছিদ্র করে তার মধ্যে সরু বেত ঢুকিয়ে হালি গেঁথে তাদেরকে জাহাজের পাটাতনের নীচে বোঝাই করে নিয়ে যেত। খাদ্যের জন্য সকাল বিকেলে ছড়িয়ে দিতো কাঁচা চাল। ভাগীরথী হতে সুদূর চট্টগ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র তাদের এইরূপ উপদ্রব চলতো। এই সব জলদস্যুদের বলতো হার্মাদ। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বলতো প্রতঙ্কীচ। প্রতাপাদিত্য এদের বংশীভূত করেন। অনেকেই তার সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিল। তখনকার কালে বাংলাদেশে দ্বাদশ ভৌমিকের প্রাধান্য ছিল। এদেরকে লোকে বার ভূঁইয়া বলে অভিহিত করত। প্রতাপাদিত্য ও বার ভূঁইয়ার অন্যতম ছিলেন। তার সৈন্যবল ক্রমশঃ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে। তার সেনাবাহিনীতে গোলন্দাজ, তীরন্দাজ, বরকন্দাজ, ঢালী, আসোয়ার (অশ্বারোহী), মল্ল প্রভৃতি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। বাঙ্গালী, পাঠান, মগ, পর্তুগীজ, কুকী প্রভৃতি বিভিন্ন জাতীয় সৈনিক তার সেনাবাহিনীতে ছিল। সেনাপতিদের মধ্যে কালিদাস রায়, বিজয়রাম ভঞ্জ, সূর্যকান্ত গুহ, সুখময় ঘোষ, কমল খোজা ও হায়দও মনক্লী ও ডুডলী প্রধান ছিলেন। তিনি কয়েকটি দুর্গও নির্মাণ করেছিলেন। ধূমঘাট, গড়কমলপুর, হয়দর গড়, সাগর দ্বীপ, বেদকাশী ও জগদ্দল তাদের মধ্যে অন্যতম। ধূমঘাটের ৪/৫ মাইল উত্তরে জাহাজঘাটায় নৌবিভাগরে সর্বাধ্যক্ষ ছিলেন পতুর্গীজ ফ্রেডারিক ডুডলী। আজো তার নামে এখানে একটি গ্রাম আছে। সম্ভবতঃ ১৫১৯ খৃষ্ঠাব্দে প্রতাপ নিজেকে স্বাধীন নরপতি বলে ঘোষনা করেন। এই সময়ে তিনি একটি বৃহৎ কল্পতরু দানযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন। কথিত আছে, যে যা চেয়েছিল প্রতাপাদিত্য তাকে তা দিয়েছিলেন। প্রতাপাদিত্য বহু পন্ডিতকে বৃত্তি দিতেন। তার সভাপণ্ডিতের মধ্যে গুরুদেব কমলনয়ন তর্ক পঞ্চানন, অবিলম্ব স্বরস্বতী সমধিক প্রসিদ্ধ। অবিলম্ব স্বরস্বতী মুখে মুখে দ্রুত দ্রুত কবিতা রচনা করতে পারতেন বলে তার নাম অবিলম্ব স্বরস্বতী হয়েছিল। ডিমডিম ছিলেন দার্শনিক পণ্ডিত। কিন্তু তিনি দ্রুত শ্লোক রচনা তৈরি করতে পারতেন না বলে তার নাম হয়েছিল ডিমডিম স্বরস্বতী। প্রতাপের পিতা বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর পর রাজ্য সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে তিনি খুল্লতাত রাজা বসন্ত রায় ও তার পুত্রগণকে হত্যা করেন। কেবল একটি পুত্র রাঘব কচু বনে লুকিয়ে রক্ষা পান। এই কারণে পরবর্তীকালে তিনি কচু রায় বলে পরিচিতি লাভ করেন। কচু রায় যশোহর রাজ-বংশের জনৈক কর্মচারী দুর্গাবাস নামক এক ব্যক্তির সহায়তায় আগ্রায় বাদশাহের নিকট উপস্থিত হয়ে প্রতাপের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। বাদশাহ প্রতাপের বিরুদ্ধে ফৌজ প্রেরণ করেন। কথিত আছে, প্রতাপ ক্রমান্বয়ে ২২ জন বাদশাহী সেনাপতিকে যুদ্ধে পরাজিত করেন। স্থানীয় লোকের বিশ্বাস রাজ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী যশোরেশ্বরীর অনুগ্রহে তিনি এই সকল যুদ্ধে জয় লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। একদিন সুরা পানে জ্ঞান হারিয়ে প্রতাপ নাকি জনৈকা অসহায়া রমণীর স্তন ছেদন করবার আদেশ দিয়েছিলেন। সেদিন দেবী যশোরেশ্বরী রাজকন্যার রূপ ধারণ করে রাজসভায় উপস্থিত হন। স্বীয় কন্যা মনে করে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে রাজপুরী হতে চলে যাবার আদেশ প্রদান করেন। দেবী “তথাস্তু” বলে অন্তর্হিত হন। প্রতাপাদিত্য মন্দিরে গমন করে দেখতে পান যে পাষাণ প্রতিমার মুখ দক্ষিণ হতে পশ্চিম দিকে ঘুরে গিয়েছে। প্রবাদ, সেইদিন হতে নাকি দক্ষিণ দিকের রাজ্য মঙ্গলময় হয়ে উঠে। যুদ্ধে মোঘল বাহিনীর পরাজয় বরণের পর মুঘল বাহিনীর পরাজয় বরণের পর মুঘল সেনাপতি রাজা মানসিংহ বহু সৈন্য-সামন্ত নিয়ে বাংলাদেশে আগমন করেন। প্রথম যুদ্ধে তিনিও পরাজিত হন। এবং সুন্দরবন অঞ্চল অঞ্চল থেকে সৈন্যদেরকে পিছে হটিয়ে নিয়ে আসেন। বর্ষাকালে খাদ্যদির অভাব দেখা দিলে সৈন্যগণের মধ্যে চরম দুর্দশা দেখা দেয়। তখন যশোহর রাজ্যের কর্মচারী দুর্গাদাস প্রতাপাদিত্যের দুর্গের জন্যে সংগৃহীত রসদ মানসিংহকে অর্পণ করেন। দুর্গাদাস সুচতুর কৌশলে এক গুপ্ত পথ দেখিয়ে রাজধানী আক্রমণের জন্য মুঘল বাহিনীকে সাহায্য করেন। মুঘল বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে কচু বা রাঘব রায় পিতৃ সম্পত্তি ফিরে পান। প্রতাপ এই সন্ধির ফলে মুঘল বাদশাহের বশ্যতা স্বীকার করেন। বাদশাহ আকবরের মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীর দিল্লীর মসনদে অধিষ্ঠিত হলে ১৬০৮ খৃষ্টাব্দে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হয়ে আসেন ইসলাম খাঁ। রাজমহল তখন সুবে বাঙলার রাজধানী। শাসনকার্যের সুবিধার জন্যে ইসলাম খাঁ রাজমহল থেকে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। প্রতাপাদিত্য এই সময় মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করতে চাইলেন না। ইসলাম খাঁ প্রতাপাদিত্যকে দমন করবার জন্যে সেনাপতি এনায়েত খাঁকে যশোহর রাজ্য আক্রমণের জন্যে প্রেরণ করেন। যুদ্ধে প্রতাপাদিত্যের নৌবাহিনী পরাজিত হয় এবং সেনাপতি কমল খোজা নিহত হন। মুঘল বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে না পেরে প্রতাপ আত্মসমর্পণ করেন। এনায়েত খাঁ তাকে বন্দী করে ঢাকায় প্রেরণ করেন। তার পরাজয় ও বন্দী হবার খবর রাজধানীতে পৌছলে রাজপরিবারে হতাশা ও শোকের ছায়া নেমে আসে। রাজকুমার উদয়াদিত্য উপান্তর না দেখে শত্র“পক্ষের উপর বীর-বিক্রমে আক্রমণ করেন। ঈশ্বরীপুরের নিকটে নকিপুরের উত্তরে কুশলীর মাঠে তিনি যুদ্ধে নিহত হন। এই দুঃখময় সংবাদ শ্রবণ করে রাজমহিষী শরৎকুমারী ও অন্যান্য রাজ অন্তঃপুরের মহিলারা শিশু-সন্তানসহ গুপ্ত সুড়ঙ্গ পথে নৌকায় করে দুর্গের বাইরে এসে নৌকার তলদেশ ছিদ্র করে জলে ডুবে জীবনাহুতি দেন। ধূমঘাট দুর্গের উত্তর-পশ্চিম কোণে সেই স্থান আজও “শরৎখানার দহ” নামে পরিচিত হয়ে আছে। এদিকে প্রতাপাদিত্য ঢাকায় কিছু কাল বন্দী অবস্থায় থেকে লৌহ পিঞ্জওে আবদ্ধ হয়ে নৌকাযোগে আগ্রায় প্রেরিত হন। পথিমধ্যে বারানসীতে ৫০ বছর বয়সে মৃত্যুমুখে পতিত হন। কথিত আছে, বারানসী চৌষট্টি যোগিনীর যে ঘাট তিনি একবার বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন এবং যার উপর কালি মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলে, সেই ঘাটে গঙ্গা স্নান করতে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। কেহ কেহ বলেন, নিজ অঙ্গুরীয়ের মধ্যে লুকায়িত জহর পান করে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্রতাপের পতনের পর যশোহর রাজ্যের সনদপ্রাপ্ত হন কচু রায়। তিনি “যশোরজিৎ” উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। দুর্গাদাস কচু রায়ের সুপারিশে কয়েকটি পরগণার মালিক হন। তিনি ভবানন্দ মজুমদার উপাধি গ্রহণ করেন। নদীয়া রাজবংশের ইনিই ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা। প্রতাপাদিত্যের রাজত্বকালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম জেসুইট সম্প্রদায় ঈশ্বরপুরের উত্তর পূর্বে ইছামতির তীরে একটি গীর্জা নির্মাণ করেন। এই গীর্জা নির্মিত হয়েছিল ১৫৯৯ খৃষ্টাব্দে। স্পেন দেশীয় জেসুইট ভ্রমণকারী ডুজারিকের (চরবৎৎব উঁ ঔধৎৎরপ) ভ্রমণ বৃত্তান্তে জানা যায় যে ঈশ্বরীপুরের গীর্জাই বাংলার প্রথম। এই গীর্জা প্রতিষ্ঠার উৎসবে ১৬০০ খৃষ্টাব্দে ১লা জানুয়ারী তারিখে প্রতাপাদিত্য যোগদান করেছিলেন। ১৫৯৮ সালে পর্তুগীজ জেসুইট পাগ্রী ফানসিস ফারনানডেজ, ডোমিনিক ডিজোসা, মেলকিওর ফনসেকা ও এনড্রু বাউয়েস প্রথম বঙ্গে আগমন করেন। ফারনানডেজ ও ফনসেকার চিঠি-পত্রে যে চ্যাণ্ডিকানের রাজার কথা আছে, তিনি প্রতাপাদিত্য বলে স্থিরীকৃত হয়েছেন। এদের চিঠি-পত্র সংগ্রহ করে ডুজারিক একটি ইতিহাস প্রণয়ন করেছেন। ঐতিহাসিকগণ বলেন ধূমঘাট ও তার নিকটবর্তী স্থানই চ্যাণ্ডিকান। প্রতাপাদিত্যের পিতা রাজা বিক্রমাদিত্য ও বসন্ত রায় গৌড়েশ্বর দায়ুদের নিকট থেকে সুন্দরবনের মধ্যে যে ভূ’সম্পত্তি প্রাপ্ত হয়েছিলেন, তার নাম চাঁদ খাঁ চক। এই চাঁদ খাঁ শব্দের বৈদেশিক বিকৃতি চ্যাণ্ডিকান। “যশোরজিৎ” কচু রায়ের বংশধরেরা অল্পকাল মাত্র যশোর রাজ্যে রাজত্ব করেছিলেন। তার বংশীয়গণের রাজত্ব ফুরিয়ে গেলে যশোর রাজ্য শাসনের জন্যে একজন ফৌজদার নিযুক্ত করা হয়। প্রথমে ফৌজদার ভূষণায় শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। পরবর্তীকালে রাজকার্যের সুবিধার জন্যে কপোতাক্ষ নদের তীরে ত্রিমোহিনীতে বাস করতে থাকেন। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে যশোরের ফৌজদার মীর্জা সকশিকান নিজ নামে প্রতিষ্ঠা করেন মীর্জা নগর। ফৌজদার আবু তোরাপের সময় ভূষণায় রাজা সীতারাম নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন। বারাসিয়া নদীর কূলে এক খণ্ড যুদ্ধে ফৌজদার আবু তোরাপ নিহত হন। পরে সীতারাম মুঘল সৈন্যের হস্তে পরাজিত হলে চাঁচড়ার রাজা মনোহর রায় নানা সূত্রে যশোর রাজ্যের অধিকাংশ পরগণার জমিদারী প্রাপ্ত হন। নবাবী আমলে চাকলার শাসনকর্তা হিসাবে একজন করে ফৌজদার  নিযুক্ত করা হতো। তারা নবাব সরকারকে কেবল রাজস্ব সংগ্রহের জন্যে সাহায্য করতেন। রাজ্যের অভ্যন্তরীণ শাসনকার্যে হস্তক্ষেপ করবার তাদের কোন প্রয়োজন পড়তো না। নবাব শায়েস্তা খাঁর আমলে ফৌজদারী অধিকারী প্রথা বিলোপ করে দেওয়া হয়। এই বিলোপের ফলে জমিদারেরা প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী হয়। বলতে গেলে সে সময় জমিদারেরা পরগণার আসল মালিক হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে তারা রাজধানীতে গমন করে কাবা চাবকান পরে, উষ্ণীষ বেধে, জানু পেতে মুসলমানী প্রথায় নবাব দরবারে সমাসীন হতেন। কোন কোন ঐতিহাসিকেরা বলেন যে, আলীবর্দীর পূর্ববর্তী নবাবগিগের আমলে বাঙালী জমিদারদিগের বিশেষ আধিপত্য ছিল না। জমিদাররেরা যথাসময়ে রাজকর পরিশোধ করতে না পারলে বিশেষ লাঞ্ছনার সম্মুখীন হতো। অনেকেই কারাগারে নিক্ষিপ্ত হতেন। কারো কারো জমিদারী অন্যের হাতেও চলে যেত। আলীবর্দীর সিংহাসনে আরোহণের পর জমিদারেরা প্রকৃতপক্ষে দেশের মাালিক হয়ে ওঠেন। আলীবর্দী তাদের পরামর্শে ভিন্ন কোন কার্য করতেন না। এই সময় চাঁচড়া হয়েছিল যশোর রাজ্যের কেন্দ্রস্থল। সেখানে ক্রমান্বয়ে বিচার বিভাগের কাছারী উঠে আসে। রাজা সীতারামের পতনের পর তার রাজ্যের একাংশ চাঁচড়ার রাজাদের অধীনস্থ হয়। বাকি অংশটুকু চলে যায় রাজশাহীর জমিদারের কর্তৃত্বাধীনে। নবাব দরবারে যশোর রাজ্যের রাজাদের প্রভাব ছিল। আলীবর্দীর মৃত্যুর পর সারা বাংলাদেশ জুড়ে জমিদারদের গোপন ষড়যন্ত্র শুরু হয়। সিরাজউদ্দৌলা বাংলার নবাব হলে তার বিরুুুুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন বাংলার জমিদারেরা। ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে নবাব সিরাজউদ্দৌলার ইংরেজদের হস্তে পরাজয় বরণের পর দেশের শাসনব্যবস্থার রদবদল হতে থাকে। ইংরেজরা তখনই প্রকৃত মালিক হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের মুর্শীদাবাদ থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করা হয় কোলকাতায়। এই সময়ে বাংলাদেশে যশোরকে প্রথম জেলায় রূপান্তরিত করা হয়। ১৭৭২ খৃষ্টাব্দে কোম্পানী সরকার রাজস্ব সংগ্রহের জন্য একজন কালেক্টর নিযুক্ত করে যশোরে প্রেরন করেন। এই কালেক্টর প্রথা বেশীদিন স্থায়ী হয়নি । ১৭৮১ খৃষ্টাব্দে এ ব্যবস্থা উঠিয়ে দিয়ে শাস্তি রক্ষার জন্যে নবাবী আমলের মতো ফৌজদারের মতো একজন শাসক নিযুক্ত করা হয়। তাকে বলা হয় ম্যাজিস্ট্রেট। এই ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্ট ও অফিসকে বলা হতো মুরলীর কাছারী। যশোরে প্রথম যিনি জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হয়ে আসেন তার নাম হেংকল। ১৭৮১ খৃষ্টাব্দে কাছারী সাহেব গঞ্জে স্থানান্তরিত করা হয়। তখন এই স্থানের নাম যশোর রাজ্যের নামানুসারে যশোর রাখা হয়। সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে খুলনাই হলো প্রথম মহকুমা। মিঃ শোর ছিলেন এই মহকুমার প্রথম এস, ডি, ও। ১৮৮১ খৃষ্টাব্দে খুলনাকে জেলায় রূপান্তরিত করা হয়। সেই সময়ে দৈনিক “স্টেটসম্যান” পত্রিকায় ২রা মে এক খবরে প্রকাশিত হয়েছিল ঃ “ঘবি উরংঃৎরপঃ ঃ ঋৎড়স ঃযব ভরৎংঃ রহংঃধহঃ ঃযব সঁপয ঃধষশবফ হবি ফরংঃৎরপঃ ড়ঃ কযঁষহধ ভড়ৎসবফ ড়ভ ঃযব ংঁন-ফরারংরড়হ ড়ভ ঝধঃশযরৎধ, ঘধৎধরষ, কযঁষহধ ধহফ ঢ়ধৎঃ ড়ভ ইধংযরৎযধঃ যধং নববহ ড়ৎমধহরুবফ ধঃ যবধফ য়ঁধৎঃবৎং ড়ভ ঃযব ংঁন-ফরারংরড়হ নবধৎরহম ঃযব হধসব ড়ভ ঃযব ফরংঃৎরপঃ. ঞযব ফরংঃৎরপঃ রং ধ ঃযরৎফ পষধংং ড়হব, যধারহম ধ উরংঃৎরপঃ গধমরংঃৎধঃব ধহফ ঈড়ষষবপঃড়ৎ ধঃ রঃং যবধফ ড়ভ ধভভধরৎং. ঞযব পযরবভ পরারষ ধহফ ঃযব ংবংংরড়হং লঁফমব ড়ভ ঔবংংড়ৎব, রঃ যধং নববহ ধৎৎধহমবফ রিষষ যড়ষফ ংবংংরড়হং ভৎড়স ঃরসব ঃড় ঃরসব ধঃ ঃযব যবধফ য়ঁধৎঃবং.”

আইন-ই-আকবরী থেকে জানা যায় যে উত্তর যশোর সরকার মোহাম্মদাবাদের অধীন ছিল। সেই সময় বাংলাদেশ ছিল ২৪টি সরকারে বিভক্ত। এই ২৪ টি সরকারের মধ্যে মোহাম্মদাবাদ অন্যতম। যশোরের দক্ষিণ অঞ্চল ছিল খলিফাতাবাদের অন্তর্গত। মোহাম্মদাবাদ ছিল এক সময় গৌড় বাংংলার টাকশাল। বর্তমান যশোর জেলা ২৫৪৭ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এখানে আর্য, দ্রাবিড়, মোঙ্গল ও আদিম অধিবাসীরা বাস করতো। প্রাচীন যশোর রাজ্যের সীমানা কতটুকু ছিল, তা’সঠিক নির্ধারণ করা যায় না। তবে এইটুকু বলা চলে, খুলনা জেলার দক্ষিনাংশ, ২৪ পরগনা, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর জেলার একাংশ জুড়ে যশোর রাজ্য বিস্তৃত ছিল। যশোর নামের উৎপত্তি নিয়ে অনেক মতবিরোধ আছে। কানিংহাম বলেন ঃ ঞযব হধসব ড়ভ ঔবংংড়ৎব (ঔধংধৎ) ঃযব নৎরফমব, ংযড়ংি ঃযব হধঃঁৎব ড়ভ ঃযব পড়ঁহঃৎু যিরপয রং পড়সঢ়ষবঃবষু রহঃবৎবংঃবফ নু ফববঢ় ধিঃবৎ পড়ঁৎংব. (ঈঁহহরহমযঁস’ং অহপরবহঃ এবড়মৎধঢ়যু. চ-৫০২০)
তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থে দেখা যায়, যশোর একটি পীঠ স্থান।
“যশোরে পানি পদ্মঞ্চ দেবতা যশোরেশ্বরী।
চণ্ডশ্চ ভৈরবো যত্র তত্র সিদ্ধিমবাপ্লূয়াৎ ॥”
-তন্ত্রচূড়ামণি
ওয়েস্টল্যাণ্ড সাহেব বলেন, গৌড়ের অগাধ ধন সম্ভারের দ্বারা এই নগরী অত্যাধিক যশস্বী হয়েছিল বলে যশোর বা যশোহর হয়েছে।
ওঃ ধিং রহঃবহবফ ঃড় বীঢ়ৎবংং ঃযব রফবধ “ঝঁঢ়বৎবসবষু মষড়ৎরড়ঁং.” (ডবংঃ খধহফ’ং জবঢ়ড়ৎঃ ড়হ ঔবংংড়ৎব, ১৮৭১. চ-৩০)
কবিরাম কৃত “উপবঙ্গে যশোরাদ্য দেশ ঃ কানন সংযুক্তা ঃ
জ্ঞাতব্য নৃপ শার্দুল বহুলাসু নদী ষূচ ॥”
ভবিষ্য পুরাণে উল্লেখিত আছে ঃ
“যশোর দেশ বিষয়ে যমুনেচ্ছা প্রসঙ্গমে,
ধূম ঘট্র পত্তনে চ ভবিষ্যন্তি ন সংশয়ঃ।”

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad