যখন অসুরদের সাথে যুদ্ধে যখন দেবতারা হেরে যান, এবং স্বর্গ রাজ্য থেকে বিতারিত হন, তখন তারা নারায়নের স্তব করতে শুরু করেন। নারায়ণ এসে ব্রহ্মাকে বললেন যে সমুদ্রকে যদি মন্থন করা হয় তবে তার থেকে অমৃত পাওয়া যাবে। সেই অমৃত পান করে সমস্ত দেবতাতাগণ অমর হয়ে যাবে। স্বর্গ রাজ্য পুনরুদ্ধার অচিরা সফল হবে।
তাই যাও, গিয়ে দেবতা আর অসুর মিলে সমুদ্রকে মন্থন কর। তোমরা অসুর দের কি ভাবে ম্যানেজ করবে সেটা ঠিক করে নাও কেননা একা দেবতা গোষ্ঠীর শক্তি নেই সে এই বিরাট কাজটাকে শেষ করতে পারবে। অমৃত পেলে পরে আমি তাঁর ব্যবস্থা করব যাতে তোমরাই সমস্তটা পেতে পার। নারায়নের এই কূটবুদ্ধিযুক্ত মন্ত্রণা পেয়ে দেবতারা উল্লসিত হলেন আর ঠিক করলেন যে সমূদ্র মন্থনের কাজ শুরু করা হোক।
কিন্তু কি দিয়ে মন্থন করা হবে। আবার নারায়ন বুদ্ধি দিলেন মন্দার পর্বতটাকে নিয়ে গিয়ে সেটাকে দিয়ে মন্থন কর। মন্দার পর্বতের কাছে গিয়ে দেখা গেল সে এক অতি বিশাল পর্বত। এগার হাজার যোজন উচু, তেমনি তার বেড়। তাকে কি করে নড়ান যাবে। সবাই মিলে চেষ্টা করে বিফল হল।
তখন বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলে বিষ্ণুর পরামর্শ অনুযায়ী নাগরাজ বাসুকী গিয়ে মন্দার পর্বতকে উপড়ে নিয়ে এলেন আর সেই পর্বতকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হল। কিন্তু পর্বত তার নিজের ওজনে সমুদ্রে ডুবে যেতে লাগল। বায়ুকে বলা হল তুমি শক্তিধর আছ, তুমি এটাকে ধরে রাখ। বায়ু বলে মন্দার পর্বত এত মোটা যে আমি তাকে হাতের বেড়ে পাবনা। তাই ধরে রাখতে পারব না। ওদিকে পর্বত তো ক্রমশঃ ডুবে যাচ্ছে।
তখন সমূদ্রেএক কূর্মরাজ থাকতেন। তাকে নানান স্তব করার পরে তিনি রাজী হলে তাঁর উপরে মন্দার পর্বতকে বসান হল। বসানর আগে ইঞ্চ্র অবশ্যি মন্দার পর্বতের তলাত দিকটাকে তাঁর বজ্র দিয়ে সমান করে কেতে দিলান যাতে পর্বতক কূর্মের পিঠে বসান যায়। কিন্তু এই সব দেখে সমূদ্ররাজ বললেন যে এই মন্থনে তো আমার অনেক ক্ষতি হতে পারে। তা আপনার যখন অমৃত পাবেন তখন যেন আমাকেও তাঁর একটু ভাগ দেওয়া হয়।
বাসুকী নাগকে বলা হল, তুমি হবে দড়ি। অসুরেরা বলল সে লেজ নিকৃষ্ট জায়গা অতএব আমরা মুখের দিকটা ধরব। তখন বাসুকির লেজ ধরল দেবতারা আর ফণা ধরল অসুরেরা। টানাটানির চোটে বাসুকির জোর জোর নিঃশ্বাস বার হতে লাগল। তাঁর নিঃশ্বাসের সেই নিঃশ্বাস ধোয়া হয়ে মেঘের সৃষ্টি করল।
মন্থনের চোটে জলে এত আলোড়ন হতে লাগল যে যেখানে যত জলচর ছিল, তারা মারা গেল। পাহাড়ের গাছপালা গুলোতে আগুন লেগে গেল। তখন দেবতারা প্রার্থনা করায় মেঘের থেকে ষ্টি এসে আগুন নিভিয়ে দিল। আর ঘষাঘষির ফলে যে সমস্ত গাছ পিশে যেতে লাগল, তাদের রস জলে পড়ায় জলের প্রানিরা আবার তাদের জীবন ফিরে পেল। এত সব কান্ড করে সবাই ভীষণ পরিশ্রান্ত হল কিন্তু অমৃত পাওয়া গেল না।
ব্রহ্মা তখন আবার বিষ্ণুর শরনাপন্ন হলে বিষ্ণুর বরে আবার সবাই গায়ে জোর পেয়ে মন্থন কাজ শুরু করল। এই বার কিছু কিছু করে সমূদ্র থেকে জিনিষ বার হতে শুরু হোল। কিছুক্ষনের মধ্যে চন্দ্রমা বা চাঁদের উতপত্তি হল, তার পরে এল ঐরাবত, চারটে বিরাট দাঁত, সাদা রঙ, পর্বত প্রমাণ সাইজ। এর পরে এল উচ্চৈশ্রবা ঘোড়া, কাল রঙ। তার পরে পারিজাত পুস্প, তার পরে এলেন ধণ্বন্তরী অমৃতের কলসী কোলে করে। সবাই আরও চাই আরও চাই করে টেনেই যাচ্ছে।
এদিকে সমূদ্ররাজ বরূন দেবতা এসে নালিশ করে বললেন যে সমস্ত জলপুরী তোলপাড় করে যে মন্থন হচ্ছে তাতে তো আমার সব কিছু ধংস হয়ে যাচ্ছে। তখন বিষ্ণু বললেন দুর্বাসার শাপে লক্ষী দেবী তোমার কাছে ছিলেন। এখন যদি লক্ষী দেবীকে নারায়নের কাছে ফেরত পাঠাও তবে তিনি মন্থন বন্ধ করে দেবেন।
এই শুনে সমূদ্ররাজ বরূন তাড়াতাড়ি লক্ষী দেবীকে চতুর্দোলায় চড়িয়ে সমুদ্রে থেকে বার করলেন। নারায়ন লক্ষী দেবীকে পেয়ে গেছেন, অমৃত নিয়ে ধণ্বন্তরিও এসে গেছেন, অতএব নারায়ণ মন্থন বন্ধ করার আজ্ঞা দিলেন। মন্থন বন্ধ হল।
ওদিকে সমস্ত দেবতা আর অসুরেরা সাগর মন্থনে ভাগ নিয়েছে, কিন্তু শিবকে কেউ ডাকেও নি আর কিছু দেবার কথাও বলে নি।। নারদ তাই দেখে শিবের কাছে গিয়ে উপস্থিত। বললেন হে মহাদেব, আপনি কি জানেন যে সমূদ্র মন্থন করে দেবতা আর অসুরেরা যে যা পাচ্ছে তাই নিয়ে নেবার কথা ভাবছে। আপনি কি কিছু পেয়েছেন বা আপনাকে কি কেউ কিছু দিয়েছে?
শিব কিছু বললেন না কিন্তু দেবী ত্রিলোচনা রাগে ক্ষেপে গিয়ে নারদ কে বললেন যে কাকে তুমি এই সব কথা বলছ? এই মহাশয়ের কি এসব দিকে কিছু খেয়াল আছে। ওনাকে কেউ ডাকল কি না তাতে ওনার কিছু এসে যায় না। এই জন্যই আমাকে দক্ষের সভাতে দেহত্যাগ করতে হয়েছিল।
গঞ্জনা শুনে শিব হেঁসে বলেন, যা অন্যেরা চায় না সেটাই তো আমার ভূষণ। দেখনা বাঘের চামড়া কেউ নিল না, তাই সেটা আমার পরিধান। সবাই অগুরু চন্দন ইত্যাদি নিল, তাই ছাইভষ্ম আমার পাউডার, সেই রকম ধুতুরা ফুল, অস্থির মালা এই সবই আমার আভূষন।
দেবী বলেন এই সব তোমার স্তোক বাক্য। ও সব কথা যদি এক গৃহী বলে তবে চলে, তোমার মুখে নয়। তোমাকে অন্য দেবতারা অবহেলা করে বলেই তোমাকে কোন খবর দেয়নি।
এইসব শুনে রাগে শিবের মাথা গরম। সাধে কি আমরা বলি নারদ নারদ। যত ঝগড়া বাধানর মূলে কিন্তু এই দেবতাটি। শিব নন্দীকে বললেন আমার রথ অর্থাৎ ষাড়টাকে সাজাও। আমি যাচ্ছি। কিন্তু কি ভাবে যাচ্ছি। যেন যুদ্ধ ঘোষনা করা হয়েছে।
যেখানে যত ভুত প্রেত, যারা শিবের অনুচর, তারা চারদিক থেকে এসে হাজির। সাথে কার্তিক ময়ুরে চড়ে , গনেশ তাঁর ইদুর বাহনে, সাথে নন্দী ভৃঙ্গী, সবাই গিয়ে সাগর পারে হাজির। গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বলি ব্যপারটা কি হচ্ছে? কি সব সমূদ্র মন্থন না কি সব হচ্ছে। কি ব্যপার? ইন্দ্র বললেন সমুদ্রমন্থন হচ্ছিল, এখন শেষ হয়েছে। নারায়ন আমাদের দিয়ে সমূদ্রমন্থন বন্ধ করিয়ে তাঁর বাড়ি গেছেন।
শিব রেগে বললেন, যে তোমাদের এত আস্পর্ধা, আমাকে কিছু না জানিয়ে মন্থন শেষ করলে। আর যা পেয়েছ, তা সব নিজেরাই নিয়ে নেবে, এটা কি করে হয়। আবার শুরু করা হোক। সব চুপ। কারুর মুখে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না।
তখন কশ্যপ মুনি বললেন, দেখুন মহাদেব, আগে দুর্বাসা মুনি ইন্দ্রকে একটা মালা দিয়েছিল পড়বার জন্য। কিন্তু ইন্দ্র সেটাকে তাঁর হাতির মাথায় রেখে দেবার পরে হাতী সেটাকে মাটিতে ফেলে দ্যায়। দুর্বাসা মুনি ক্ষেপে গিয়ে শাপ দেন সমস্ত দেবতা দেবিরা তাদের শক্তি হারাবেন আর লক্ষী দেবী সাগরে গিয়ে থাকবেন।
শক্তি হারানর পরে দেবতারা তাদের রাজ্য হারান। পরে তারা নারায়ন কে পুজা করে তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ পান যে সাগর মন্থন করলে তারা তাদের হারান শক্তি ফিরে পাবেন। নারায়ন সাগর মন্থনের আজ্ঞা দিয়েছিলেন, লক্ষী দেবীকে পেয়ে সাগর মন্থন বন্ধ করিয়ে নারায়ণ বাড়ি গেছেন। এখন আপনি আবার বলছেন মন্থন শুরু করতে।
এদিকে সবাই ক্লান্ত, নাগরাজের সমস্ত হাড়গোড় ভেঙ্গে চুরমার, মুখ দিয়ে লালা বেরচ্ছে। বরুন দেবের ঘরবাড়ি সব নষ্ট হয়ে গেছে, এর পরে আর একবার মন্থন করবার জন্য বলবেন না, প্লীজ।
শিব বললেন, আমি এসেছি আমার জন্য অন্তত আর একবার সুরু কর। শিবের কথা না মানলে বিপদ তাই আবার শুরু হল। এই বার কিন্তু টানা টানির চোটে নাগরাজের মুখ থেকে বিষ বার হতে শুরু হল। মন্দার পর্বতে ঘষাঘষির ফলে দাবানল জ্বলে উঠল। সব দেবতারা পালাতে শুরু করল।
বিষে সমস্ত চরাচর বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে দেখে দেবতাদের স্তুতিতে তুষ্ট হয়ে শিব এক চুমুকে সেই বিষটাকে নিয়ে নিজের গলাতে রাখলেন, পান করলেন না। তাই থেকে তাঁর নাম হল নীলকন্ঠ।
তখন শিব আদেশ করলেন যে এবার আর মন্থন করে কাজ নেই, মন্দার পর্বত নিয়ে যেখানে ছিল সেখানে নিয়ে গিয়ে রাখ। কারুর আর গায়ে জোর নেই, শেষ পর্যন্ত শিব নিজেই মন্দার পর্বত কে নিয়ে তাঁর জায়গাতে রেখে দিলেন।
কিন্তু যে জিনিষ গুলো মন্থনে বার হল সেগুলোর কি বাটোয়ারা হল।। লক্ষী তো নারায়নের কাছে গেল। রম্ভা, মেনকা, ঊর্বশী এরা সব দেবলোকে গেল। সুরা দেবী অসুরের দিকে গেল। কামধেনু গেল বিষ্ণুর ভাগে। ঐরাবত গেল ইন্দ্রের কাছে আর উচ্চৈঃশ্রবাঃ গেল অসুরদের কাছে। মণিমানিক্যের মধ্যে কৌস্তুভ নিলেন বিষ্ণু। পারিজাত গেল দেবলোকে। চন্দ্র গেল শিবের জটায়। আর অসুরেরা একজোট হয়ে সুধার কলসি নিয়ে নিল।
বিপদ দেখে শিব বলে ঝগড়া করবে না আমি ঠিক করছি। ইতিমধ্যে নারায়ন মেয়ে সেজে এসে হাজির। তাঁর কি সে রূপ। ঐ রূপলাবণ্যে সবাই মোহিত। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া থামিয়ে সবাই সেই মোহিনী রূপ দেখতে লাগলো।
সুযোগ বুঝে গরুড় এসে অমৃতের কলসী নিয়ে পালাল। যাবার পথে কলসি থেকে চার ফোঁটা অমৃত পৃথিবীতে পড়ে যায়। সেই চার জায়গাতে এখন কুম্ভ মেলা হয়। এ দিকে মোহিনীবেশী নারায়ণ গরুড়ের কাছ থেকে অমৃত নিয়ে বিলি করবার জন্য সবাইকে লাইন দিয়ে বসালেন।
তাঁর পরে প্রথমে দেবতাদের দিক থেকে অমৃত পান করানো শুরু করলেন। অসুরেরা দেখল যে দেবতারা সব অমৃত আগে পান করে নিলে তাদের ভাগে কিছুই থাকবে না, আর নারায়ন খেয়াল রাখছিলেন যেন কেউ লাইন না ভেঙ্গে আগে ঢুকে আসে। কিন্তু রাহুকেতু নামে এক অসুর দেবতাদের মধ্যে গিয়ে লুকিয়ে দেবতা সেজে অমৃত খেয়ে নেয়। সুর্য আর চন্দ্র সেটা দেখতে পায়। নারায়ন তখন তাদের গলা কেটে দিতে রাহু আর কেতু আলাদা হয়ে দু টুকরো হয়ে যায়। কিন্তু অমৃত খাবার ফলে তাদের মৃত্যু হয় না, তারা আকাশে ঘুরে বেড়াতে থাকে। আর সেদিন থেকে রাহু আর কেতুর সাথে স্যররয আর চন্দ্রের শত্রুতা, এরা সুর্য আর চন্দ্রকে দেখতে পেলেই খেয়ে নেয় কিন্তু গলা কাতা থাকাতে তাদের আর হজম করতে পারেনা।
ব্যাসদেব রচিত মহাভারতের শ্রীকাশীরাম দাসের বাংলা অনুবাদ এবং শ্রী রাজশেখর বসুর সারানুবাদ অবলম্বনে লেখা।
কাহিনীটি মোটেই কাশীদাসী বা রাজশেখর বসুর মহাভারত অনুসারে বর্ণিত নয়, বরং ঢপের কেত্তন। বলতে বাধ্য হচ্ছি লেখার ধরণ ও ভাষা জঘন্য।
ReplyDelete