ইতিহাসঃ ভারতের ভাগ বাটোয়ারা - Human Timelines Myth & History

Hot

Post Top Ad

Saturday, February 17, 2018

ইতিহাসঃ ভারতের ভাগ বাটোয়ারা


ভারতের ভাগ বাটোয়ারা ভাষা বা অর্থনৈতিক দিক থেকে
দু তিন দিন আগে ভারতের সংসদ এক আইন পাশ করে অন্ধ্র প্রদেশকে দু টুকরো করে তেলেঙ্গানা আর সীমান্ধ্র, দুটি প্রদেশের সৃষ্টি করেছেন। তাই নিয়ে তুমুল হৈ হট্টগোল সংসদে এবং সংসদের বাইরে শুরু হয়েছে। আমার এই লেখার মুলে এই বক্তব্য আছে , যে প্রয়োজন পড়লে এই ধরনের বিভাজন বা সংযোজন রাজনীতিতে বহুবার হয়েছে আর কিছুদিনের মধ্যে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়েছে। এই আন্দোলন মূলতঃ ভাষা নিয়ে হয়, যদিও তেলেঙ্গানার ক্ষেত্রে এটা অর্থনৈতিক দিক থেকে হচ্ছে।


ভারতবর্ষে ইসলামী শাসনের আগমনের আগের চেহারা্টা ছিল কতকগুলি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সমষ্টি, যারা একে ওপরের বিরুদ্ধে সুযোগ পেলেই রাজ্য বিস্তারের জন্য যুদ্ধ ঘোষনা করতে দ্বিধা বোধ করেনি। এই রাজ্যগুলির ভাষা এবং সংস্কৃতি বিভিন্ন ধরনের ছিল। মুঘল আমলেই প্রথম ভারতবর্ষকে একটা বিরাট সাম্রাজ্যের চেহারাতে দেখা যায়। তাতে ফার্সী ভাষার উপরে বিশেষ জোড় এল কেননা সেটা রাজভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল।


তার পরে বৃটিশ শাসনে ভারতবর্শ আসার পরে সমস্ত দেশতা এক রাষ্ট্র হিসাবে দেখাতে লাগে যেখানে আঞ্চলিক ভাষা চলতে থাকলেও ইংরাজী ভাষার উপরে জোর দেওয়া হতে লাগল। কিন্তু রাজ্যের সুশাসনের নামে যখন দরকার মনে হয়েছে তখনই ভারতের অঙ্গরাজ্যের চেহারাগুলোকে পালটান হয়েছে। তখন কিন্তু রাজ্যগুলি থেকে তাদের আপত্তির কোন দাম দেওয়া হয়নি। এই কথাটি কিন্তু প্রায় প্রত্যেক রাজ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।


প্রথমেই দেখি ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষের চেহারাটা। সারা ভারত তখন তিনটি প্রদেশে ভাগ করা আছে, (১) বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী, (২) মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সী আর (৩) বম্বে প্রেসিডেন্সী। এছাড়া বাকী রয়ে গেছে করদ রাজ্য সমূহ। বেঙ্গল প্রেসীডেন্সীর বিস্তার ছিল বাংলা থেকে গঙ্গা যমুনার অববাহিকা ধরে দিল্লী পর্যন্ত। বম্বে প্রেসিডেন্সির বিস্তার ছিল বর্তমান ভারতের পশ্চিম ঊপকূল অর্থাৎ গোয়া, কোঙ্কণ উপকূল ধরে সৌরাষ্ট্র পর্যন্ত। আর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সী ছিল বর্তমান তামিলনাডু, সীমান্ধ্র, ওড়িশা নিয়ে পূর্ব ঊপকূল ধরে।


করদ রাজ্য গুলির মধ্যে মূলতঃ ছিল কাশ্মীরে গোলাবসিং এর রাজত্ব, পাঞ্জাবে শিখ রাজত্ব, মধ্য ভারতে এবং পুর্ব মহারাষ্ট্রে পেশোয়ার রাজত্ব। হায়দ্রাবাদে আসিফ যাইর রাজত্ব। আর দক্ষিণে ট্রাভাঙ্কোর আর টিপু সুলতানের রাজত্ব। এছাড়া রাজপুতানাতে রাজপুতদের বিভিন্ন রাজত্ব। এ ছাড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কিছু খুচরো রাজ্য, যেমন মধ্য প্রদেশে রতলাম বা উড়িষ্যার কেওঞ্ঝর কিম্বা সৌরাষ্ট্রের জুনাগড় ইত্যাদি। মনে রাখা দরকার ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার সময়ে ভারতবর্ষে মোট করদ রাজ্যের সংখ্যা ছিল ৫৬২টি।


আমি প্রথমে নেব আসাম প্রদেশের অবস্থাটা । খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দিতে আসামে রাজত্ব করত অহোম রাজারা আর কোচ বংশের রাজারা। অহোমেরা ছিল তাই বংশীয় আর কোচেদের উৎপত্তি ছিল বর্মী-ভুটানী সংমিশ্রণে। কোচেদের রাজত্ব ছিল পশ্চিম আসাম, উত্তর বঙ্গ জুড়ে আর অহোমেরা ছিল ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকাতে মূলতঃ; উত্তর আসামে। কিন্তু কোচ সাম্রাজ্যের অবনতির সাথে সাথে তাদের সাম্রাজ্য ভেঙ্গে দু টুকরো হয়ে যায়। পশ্চিম অংশ মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় আর পুর্ব দিকটা অহোম সাম্রাজ্যের অনুগামী হয়। মুঘল শাসন কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আসাম দখল করতে পারেনি।


কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দির শেষের দিকে অহোম রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী শ্রীবরগোহাইন এবং অহোম রাজার প্রতিনিধি শ্রীবরফুকনের মধ্যে বিবাদের পরে অন্য দলকে হারানর জন্য শ্রীবরফুকন, বর্মার (বর্তমান মায়ানমার) রাজার কাছে সাহায্য চায়। বর্মীরা অহোম রাজ্য আক্রমণ করেএবং বর্মীদের আক্রমণে সমগ্র আসাম বর্মার দখলে আসে। সাধারণ জনতার উপরে বর্মী অত্যাচারের ফলে তারা বৃটিশ রাজত্বে আশ্রয় নেয়। যখন এই বর্মীরা ইংরেজ রাজত্বের উপরে আক্রমণ করে তখন ইঙ্গ বর্মা যুদ্ধ বাধে।


১৮২৪ সালে ইঙ্গ-বর্মী প্রথম যুদ্ধে বর্মা হেরে গেলে আসামের পশ্চিম ভাগ বৃটিশদের অধীনে আসে। আর এই খন্ডটাকে ১৮৩৮ সালে বাংলার (বেঙ্গল প্রেসীডেন্সির) সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। পরে দ্বিতীয় (১৮৫২) এবং তৃতীয় (১৮৮৫) ইঙ্গ-বর্মী যুদ্ধের পরে সম্পূর্ণ বর্মা বৃটিশদের দখলে আসে এবং সমস্ত আসাম রাজ্য বৃটিশদের কবলে আসে। ১৮৮৬ সাল থেকে সমগ্র আসাম কে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর অংশ হিসাবে গণ্য করা শুরু হয়।


১৯০৬ সালে আসাম কে পূর্ব বাংলা এবং আসাম প্রদেশের অঙ্গ হিসাবে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়। ১৯৩৭ সালে আসাম কে আলাদা প্রদেশ হিসাবে মান্যতা দেওয়া হয়। এই সময় সমগ্র পূর্বোত্তর ভারতের রাজ্য ছিল আসাম আর করদ রাজ্য ত্রিপুরা এবং মণিপুর।


ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পরে এই অঞ্চলে নাগাল্যান্ড (১৯৬৩), মেঘালয়(১৯৭২), এবং মিজোরাম(১৯৮৭) এর সৃষ্টি করা হয়। মেঘালয় নামে যে জায়গাটাকে আমরা আজ জানি সেই জায়গাটা (খাসি এবং জয়ন্তী পাহাড় অঞ্চল) বাংলার সাথে ১৯০৫ সালে জুড়ে দেওয়া হয় কিন্তু বঙ্গ ভঙ্গ রদ হবার পরে ১৯১২ সালে এই অঞ্চলটাকে বাংলার থেকে আলাদা করে আসামের সাথে যুক্ত করা হয়।


উত্তর পূর্ব সীমান্ত অঞ্চল (নেফা) কে অরুনাচলে(১৯৭২) রূপান্তরিত করা হয় এবং ১৯৮৭ তে রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে।। ত্রিপুরা এবং মণিপুর ১৯৭২ সালে পুর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পায়।
এখানে আঞ্চলিক ভাষা গুলি আমরা দেখে নি। মেঘালয় অঞ্চলের ভাষা হচ্ছে মূলত খাসী এবং গারো উপজাতির ভাষা। নাগাল্যান্ডের অধিবাসী নাগা উপজাতি এবং প্রত্যেক উপজাতির একটা নিজস্ব ভাষা আছে। বৃটিশেরা যখন ভারত ছেড়ে চলে যায় তখন মিজোরামে প্রায় ২০০ মত মিজো উপজাতি ছিল আর তাদের প্রত্যেকে নিজস্ব স্থানীয় ভাষা ছিল। এটাও ঠিক যে খৃষ্টান ধর্মযাজকদের প্রভাবে মিজো ভাষার (লুসাই ভাষা থেক উতপন্ন) চেয়ে ইংরাজীর প্রচলন বেশী। ত্রিপুরাতে প্রধান ভাষা ছিল ত্রিপুরী কিন্তু বাংলা দেশ থেকে উদ্বাস্তু আগমনের ফলে বাংলাভাষীর সংখ্যা এখন বেশী। মণিপুরে ভাষা মনিপুরী। আসামে অহমিয়া।




কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে রাজকার্যের সুবিধার জন্য রাজ্যকে ভাগ করে টুকরো করা হয়েছে। আবার যখন দরকার মনে হয়েছে তখনই মুল রাজ্য থেকে ছোট ছোট উপরাজ্য কেটে বার করে নিয়ে তাদের নতুন রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এখানে একটা ছোট্ট মানচিত্র দিচ্ছি যাতে ১৯৪৭ সালের আসাম প্রদেশের চেহারাটা দেখা যাবে। মনে রাখা দরকার বর্তমান আসামে কিন্তু অসমীয়া, বাংলা ছাড়া বোরো, সান্তালী ভাষাভাষীদের সংখ্যা প্রচুর এবং সেই কারণে তাদের আঞ্চলিক স্বাতন্ত্রতার দাবী রয়ে যাচ্ছে।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad