গ্রীক বীর অ্যালেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের কথা আমরা সবাই জানি। ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই বীর বিভিন্ন দেশ জয় করে যখন ভারত আক্রমণ করেন, তখন রাজা পুরুসের সাথে তাঁর তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের শেষে রাজা পুরুসকে ধরে আনা হয় অ্যালেক্সান্ডারের সামনে আহত অবস্থায়। আলেক্সান্ডার রাজা পুরুসকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি আমার কাছ থেকে কী ধরণের আচরণ আশা করেন।“ রাজা পুরুসের উত্তর, “একজন রাজার আরেকজন রাজার সাথে যেরকম আচরণ করা উচিত, সেরকম।“ রাজা পুরুসের উত্তর শুনে অ্যালেক্সান্ডার তাঁকে মুক্তি দেন ও তাঁর রাজ্য তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে ভারত ত্যাগ করেন।
এ হলো জানা ইতিহাস। জাসলিন, প্লুটার্ক, ডিওডরস, আরিয়ানের মত ঐতিহাসিকদের বলে যাওয়া ইতিহাস। কিন্তু তাঁদের লিখে যাওয়া ইতিহাসের অসংলগ্ন কথাবার্তাই এতদিনের জানা ইতিহাসকে করছে প্রশ্নবিদ্ধ। ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অ্যালেক্সান্ডার দ্য গ্রেট তাঁর দুর্দান্ত ইউরোপিয়ান সেনাবাহিনী, যুদ্ধপ্রিয় ম্যাসিডোনিয়ান সেনাবাহিনী, গ্রীক অশ্বারোহী সৈন্যদল, বলকান যোদ্ধা ও পারস্য মিত্রদের নিয়ে ভারত আক্রমণ করেন। এ সেনাবাহিনীতে যোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৪১ হাজারেরও বেশি। পশ্চিম পাঞ্জাবের রাজা পুরুসের সাথে ঝিলম নদীর তীরে অ্যালেক্সান্ডারের ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই ঘটনার এতদিন পর ব্রিটিশ ইতিহাসবিদরা শোনাচ্ছেন ভিন্ন কথা। ভারতে অ্যালেক্সান্ডার জয়ী হন নি, বরং হয়েছিলেন শোচনীয়ভাবে পরাজিত। আর ইতিহাস পরিবর্তনের জন্য দায়ী পরবর্তী সময়ে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতার কারণে শিল্প-সাহিত্য ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া ও ইউরোপীয় দেশগুলোর ইতিহাস পরিবর্তন করে ফেলার মানসিকতা।
১৯৫৭ সালে ভারতের দেরাদুনে মার্শাল গ্রেগরি ঝুকভ ভারতীয় মিলিটারি একাডেমীর ক্যাডেটদের সামনে এক বক্তব্যে বলেন,ভারতে অ্যালেক্সান্ডার ভয়াবহভাবে পরাজিত হন। আর সেই পরাজয় নেপোলিয়নের রাশিয়াতে পরাজিত হওয়ার ঘটনার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। অ্যালেক্সান্ডার ভারতীয় সীমান্তে প্রবেশের সাথে সাথে পেশোয়ারসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। বেশ কিছু তথ্য অনুসারে, তারা তাদের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত যুদ্ধ করে গিয়েছে। আফগানিস্তান ও পেশোয়ারের মধ্যবর্তী উপত্যকার মানুষকে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় ‘আসাকেনয়’। এদের দ্বারা মাসাজা, ওরা ও বাজিল নামক জায়গায় গ্রীক সেনারা ভয়াবহ প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। মাসাজার রক্তাক্ত যুদ্ধ ভারতে আলেক্সন্ডারের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল। যুদ্ধের প্রথম দিন গ্রিক ও মেসিডোনিয়ান সেনারা ব্যপক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়। অ্যালেক্সান্ডার নিজে পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা পান। যুদ্ধের চতুর্থ দিন মাসাজার রাজা আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানান। তাঁকে হত্যা করা হয়। এরপর রাজ্যের দায়িত্ব নেন সেই রাজার মা এবং এই ঘটনার সাথে মাসাজাসহ আশেপাশের এলাকার সবাই অ্যালেক্সান্ডারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে নামে। ভারতের প্রতিটি স্থানে নিজের পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে দেখে অ্যালেক্সান্ডার ফন্দি আঁটলেন। তিনি মাসাজার রাণীকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিলেন। মাসাজার রাণী ও সেনারা অ্যালেক্সান্ডারের পাতা ফাঁদে পা দিলেন। মাসাজাতে যখন যুদ্ধবিরতি উপলক্ষ্যে আনন্দোৎসব শেষে ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাতের আঁধারে অ্যালেক্সান্ডারের সেনারা শহরে প্রবেশ করে শহরের প্রতিটি মানুষকে হত্যা করে, একই গণহত্যা চলে ওরা নগরীতেও। এ ঘটনার ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিরোধ শক্তি কিছুটা হলেও কমে যায়।
অ্যালেক্সান্ডার ভারতে তাঁর সবচেয়ে শক্ত প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হন ঝিলম নদীর তীরে, রাজার পুরুসের সাথে। গ্রিক সূত্র অনুযায়ী, তাঁর উচ্চতা ছিল সাত ফুট। ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মে মাসে এই ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ৩৪ হাজার মেসিডোনিয়ান পদাতিক সেনা ও ৭০০০ গ্রিক অশ্বারোহী সেনা নিয়ে অ্যালেক্সান্ডার অগ্রসর হন। তাঁকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসেন রাজা পুরুসের প্রতিদ্বন্দ্বী তক্ষশীলার রাজা আম্ভি, যিনি পুরুসকে নিজের পথের কাঁটা ভাবতেন। উল্টোদিকে রাজা পুরুসের সেনাবাহিনীতে ছিল ২০ হাজার পদাতিক সেনা, ২০০০ অশ্বারোহী ও ২০০ যোদ্ধা হাতি। পার্বত্য অঞ্চলে পুরুসের যোদ্ধারা গ্রিক সেনাদের উপর ভয়াবহ আঘাত হানলো। এছাড়া তাদের হাতিগুলো গ্রিক সেনাদলের ঘোড়াগুলোকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলছিল। এছাড়া হাতিগুলোর পায়ের নিচে চাপা পড়ে হতাহত হচ্ছিল গ্রিক সেনারা। এছাড়া ছিল বিশাল বিশাল বর্শা, যেগুলো একেক জন গ্রিক সেনাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছিল। এর ফলে গ্রিক সেনারা পিছু হটে যেতে শুরু করে। তখন যোদ্ধা হাতিগুলো দ্রুত গতিতে এগিয়ে গিয়ে হয় তাদেরকে পিষে ফেলে, না হয় শুঁড়ে পেঁচিয়ে নিজেদের সেনাবাহিনীর কাছে নিয়ে আসে। সে এক ভয়াবহ দৃশ্য! যুদ্ধের এক পর্যায়ে রাজা পুরুসের ভাই অমর আলেকান্ডারের প্রিয় ঘোড়া বুসেফালুসকে হত্যা করেন, যার ফলে অ্যালেক্সান্ডারকে মাটিতে নেমে আসতে হয়। শুধু তাই নয়, পুরুসের সেনারা অ্যালেক্সান্ডারের সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম হয় ও তাঁর প্রধান সেনাপতিদের একজন নিকাইয়াকে হত্যা করে। রাজা পুরুস অ্যালেক্সান্ডারকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহবান জানান, যাতে অ্যালেক্সান্ডার ঘোড়া থেকে পড়ে যান। পুরুস তাঁকে হত্যা করবেন কিনা ভাবতে দেরি করে ফেলেন। এর মাঝে অ্যালেক্সান্ডারের দেহরক্ষীরা তাঁকে সরিয়ে নেয়। প্রবল প্রতিরোধের মুখে অ্যালেক্সান্ডার পিছু হটে যান যখন শুনেন মগধের রাজা নন্দ তাঁর ২ লাখ পদাতিক সৈন্য, ৮০ হাজার অশ্বারোহী সেনা, ৮ হাজার যুদ্ধযান ও ৬ হাজার যোদ্ধা হাতি নিতে তাঁকে প্রতিরোধের জন্য অপেক্ষা করছেন।
সমুদ্রপথের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় অ্যালেক্সান্ডার ও তাঁর সেনাবাহিনী ভারতের প্রতিটি স্থানে স্থানীয় রাজা কিংবা প্রাদেশিক প্রধানদের তাড়া খেয়েছেন। পাঞ্জাবের সাঙ্গালার কাছে এই আক্রমণ এতটাই তীব্র ছিল যে অ্যালেক্সান্ডারকে মাটিতে নেমে যুদ্ধ করতে হয়, তাঁর সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অ্যালেক্সান্ডারের বুক ও পাঁজরে বর্শা গেঁথে যায়, যা তাঁকে আর কোন অভিযান করতে দেয় নি। আহত অবস্থায় অ্যালেক্সান্ডার ব্যবিলনে (ইরাক) ৩৩ বছর বয়সে মারা যান।
No comments:
Post a Comment