সোনারগাঁও সম্বন্ধে এখানে কিছু বলে নি। দেব বংশীয় রাজা দনুজমাধব দশরথ দেব, সেন বংশের রাজাকে পরাস্ত করে বিক্রমপুর থেকে তার রাজধানী তুলে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সোনারগাঁওতে নিয়ে আসেন। কিন্তু সামশুদ্দিন ফিরোজ শাহের আক্রমণে পরাজিত হলে সোনারগাওতে মুসলিম শাসনের শুরু হয়। যদিও এর আগে সুফি সন্তেরা সোনারগাওতে এসে তাদের মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পরে তার ছেলে গিয়াসুদ্দিন বাহাদুর শাহ ১৩২২ খৃষ্টাব্দে সুলতান হলে দিল্লির সুলতান গিয়াসুদ্দিন তুঘলক তাঁকে যুদ্ধে পরাজিত করে বন্দি করেন। কিতু গিয়াসুদ্দিন তুঘলকের মৃত্যু হলে তার ছেলে মহম্মদ বিন তুঘলক সুলতান হন এবং বাহাদুর শাহকে মুক্তি দিয়ে তাঁকে সোনারগাঁও র গভর্ণর হিসাবে নিযুক্ত করেন। চার বছর গভর্ণর হিসাবে শাসন করার পরে বাহাদুর শাহ ১৩২৮ খৃষ্টাব্দে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক তার সেনাপতি বাহরাম খান কে পাঠান বিদ্রোহ দমন করতে, বাহাদুর শাহের সাথে যুদ্ধে পরাজয় ঘটে এবং তার মৃত্যু হয়। বাহরাম খান সোনারগাঁও এর গভর্নর নিযুক্ত হন।
১৩৩৮ খৃষ্টাব্দে বাহরাম শাহের মৃত্যু হলে তার অঙ্গরক্ষক ফকরুদ্দিন মুবারক শাহ নিজেকে সোনারগাঁর স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষনা করেন। সেই সময় লাখনউটি বা গৌড়ে হাজী ইলিয়াস মুঘলদের হয়ে সুলতান হিসাবে শাসন করছিলেন। ১৩৪২ খৃষ্টাব্দে ফকরুদ্দিন শাহের মৃত্যু হলে তার পুত্র ইখতিয়ারউদ্দিন গাজী শাহ সুলতান হন। এর তিন বছর বাদে গৌড়ের সুলতান ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁও আক্রমণ করেন এবং সোনারগাঁও জয় করেন। তিনি সাতগাও(সপ্তগ্রাম), সোনারগাঁও এবং গৌড় (লাখনাখৌটি বা লক্ষনাবতী) এক করে সমগ্র বাংলার সুলতান হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৪৩৫ খৃষ্টাব্দে শামসুদ্দিন আহমদ শাহের মৃত্যু হলে সভাসদেরা নাসিরুদ্দিনকে সিংহাসনে বসান। নাসিরুদ্দিন নিজে নাসিরুদ্দিন মহম্মদ শাহ নাম নিয়ে সুলতান হিসাবে রাজত্ব করতে থাকেন।
ইলিয়াস শাহী বংশের মধ্যে আমরা রাজা গণেশের কিছু অংশ পাই। ১৪১৫ থেকে ১৪৩৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজা গণেশের শাসন ছিল। রাজা গণেশ দিনাজপুরের গভর্ণর, এবং ভাতুরিয়ার এক জমিদার ছিলেন। কারুর মতে রাজা গণেশ গিয়াসউদ্দিন মহম্মদ আজম শাহ কে হত্যা করেন, কিন্তু অন্যদের মতে গিয়াসউদ্দিন শাহের মৃত্যু সাধারণ ভাবেই হয়েছিল। গিয়াসুদ্দিনের মৃত্যুর পরে তার পুত্র সইফুদ্দিন হামজা শাহ দু বছর রাজত্ব করার পরে শিহাবুদ্দিন বায়াজিদ শাহসুলতান হন। কারুর মতে রাজা গণেশের কাছে শিহাবুদ্দিনের মৃত্যু হয় আবার কারুর মতে শিহাবুদ্দিনের পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহের মৃত্যু হয়। যাই হোক না কেন এই মৃত্যুর ফলে ইলিয়াস শাহী বংশের বদলে রাজা গনেশের হিন্দু রাজত্ব স্থাপিত হয়।
রাজা গণেশের রাজত্বের সময় ঐতিহাসিক ফিরিস্তার মতে হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি ছিল, যদিও ঐতিহাসিক রিয়াজের মতে গৌড় বা পান্ডুয়ার মুসলিমদের উপর অত্যাচার হয়েছিল। শেখ নুর কুতব উল আলম এক চিঠি লিখে জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শাহ সারকি কে বাংলা দেশ আক্রমণ করতে ডেকে পাঠান।মুল্লা তাকিয়ার মতে ইব্রাহিম শাহ যখন রাজা গণেশকে শিক্ষা দেবার জন্য অগ্রসর হন তখন মিথিলার রাজা শিবসিংহএর কাছে বাধা পান।
ইব্রাহিম শাহের আক্রমণ সম্বন্ধে নানান মত আছে। কেউ বলেন যে ইব্রাহিম শাহের মুল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের পুর্ব দিকে কোন রাষ্ট্র। আবার আব্দুর রজ্জক সমরখন্ডীর মতে হেরাতের তিমুরিদ বংশীয় সুলতান শাহরুখের (মতান্তরে তিমুরের পুত্র) কাছ থেকে ইব্রাহিম শাহ এই মর্মে নির্দেশ পান যে বাংলা দেশ আক্রান্ত হলে হেরাতের সুলতান শাহরুখ বাংলা দেশকে সাহায্য করবেন। যার ফলে ইব্রাহিম শাহ রাজা গণেশের বিরুদ্ধে আর অগ্রসর হতে সাহস পান নি। মুল ফারসী ভাষায় লেখা চিঠিতার সারাংশ এখানে দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না।
ফরমানে লেখা হয়েছিল, “আমার এই ফরমান তোমার হাতে পৌঁছানর এক দিনের মধ্যে তুমি যে সমস্ত গৌড় এর মুসলমান নাগরিকদের বন্দী বানিয়েছ তাদের সসন্মানে নিজের নিজের ঘরে পৌঁছে দেবার বন্দোবস্ত করবে, এবং তাদের ক্ষতির সমূচিতভাবে ক্ষতি পুরন করবে। এ কথার অন্যথা হলে আমি কাবুলের রাজাকে তার সমস্ত সঙ্গীদের নিয়ে তোমাকে আক্রমণ করতে আদেশ দেব। এতেও তুমি যদি না বুঝতে চাও তবে সমস্ত মধ্য প্রাচ্যের (জায়গাগুলোর নাম করে) রাজ্য গুলিতে যারা শাসন করছে তাদের আদেশ দেব যে তোমাকে তারা গিয়ে যেন উচিত শাস্তি দেন। এতেও যদি না মানবার ইচ্ছে থাকে তবে সুদূর তুর্কিস্থানের রাজাকেও বলব সে যেন তোমাকে হত্যা করার বন্দোবস্ত করেন। তাতে যদি তোমার সদবুদ্ধি না জাগে তবে আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী যোদ্ধাদের পাঠাব তোমাকে টুকরো টুকরো করে কাক দিয়ে মাংস খাওয়াতে।“আমার ভাষাতে তেমন জোর নেই, কিন্তু চিঠিটা এতই কাজ দিয়েছিল সে ইব্রাহিম শারকী তৎক্ষণাৎ পেছন ফেরেন। গৌড়ে আর আক্রমণ হয় না।
কিন্তু রাজা গণেশ ইব্রাহিম শাহের আক্রমণের ভয়ে শেখ নুর কুতব উল আলমের কাছে ভরসা চাইলে, তিনি রাজা গনেশের পুত্র যদুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। যদু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে জালালুদ্দিন মহম্মদ শাহ নামে শাসন করতে শুরু করেন। কিন্তু ইব্রাহিম শাহ জৌনপুরে ফেরত গেলেই আবার রাজা গণেশ সিংহাসনে বসেন।পরে যদুর কিছু ভৃত্যের হাতে রাজা গণেশের মৃত্য হয়, যদু আবার জালালুদ্দিন নামে শাসন শুরু করেন।
শ্রী যদুনাথ সরকারের মতে রাজা গনেশ দনুজমর্দনদেব নামেও পরিচিত ছিলেন। তার মৃত্যুর পরে তার দ্বিতীয় পুত্র মহেন্দ্রদেব নামে সিংহাসনে বসেন। পরে গণেশের প্রথম পুত্র জালালুদ্দিন সুলতান হয়ে বসেন। কিন্তু ঐতিহাসিক নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতে গণেশের মৃত্যর পরে জালাউদ্দিন আবার হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত হয়ে মহেন্দ্রদেব নামে শাসন শুরু করেন। এবং পরে আবার জালালুদ্দিন নামে শাসন করেন। জালালুদ্দিন মহম্মদ শাহের পরে ছ জন পর পর সুলতান হন। শেষ ইলিয়াস শাহী বংশের সুলতান ছিলেন জালালুদ্দিন ফতেহ শাহ। যদিও তার সাম্রাজ্য পুর্বে শ্রীহট্ট থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে দামোদর নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তবুও ১৪৮৭ খৃষ্টাব্দে তার এক হাবসী সেনাধ্যক্ষের হাতে তার মৃত্যু হয়।
হাবসী সেনাধ্যক্ষ শাহজাদা বারবাক নাম নিয়ে সুলতান হন।কিন্তুআর একজন হাবসী সেনাধ্যক্ষ সইফুদ্দিন ফিরোজ শাহের হাতে সুলতান বারবাকের মৃত্যু ঘটে। সইফুদ্দিন সুলতান হিসাবে রাজত্ব শুরু করেন। ১৪৯৪ খৃষ্টাব্দেহাবসি বংশের শেষ সুলতান শামসুদ্দিন মুজাফফর শাহ তার ওয়াজির সৈয়দ হুসেনের হাতে মারা যান। সৈয়দ হুসেন নিজে আলাউদ্দিন হুসেন শাহ নাম নিয়ে সুলতান হয়ে হুসেন শাহী বংশের পত্তন করেন।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ কে বাংলার সুলতানদের মধ্য সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়। তার রাজ্য কামরূপ (বর্তমান পূর্ব আসাম), কামতা (বর্তমান কোচবিহার এলাকা, খেন রাজ বশের শেষ রাজা মীলাম্বর কে হারিয়ে)), জাজনগর (ওড়িষ্যার পূর্ব দিকের অংশ)এবং ওড়িষ্যা পর্সন্ত বিস্তৃত ছিল।কিন্তু ভুইয়াদের আক্রমনে আবার ১৫০৫ খৃষ্টাব্দের কোচ বংশেরশাসনেরপুনরায় আগমন ঘটে। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এর পরে সুলতান হন নাসিরুদ্দিন নসরত শাহ এবং তার পরে মাহমুদ শাহ। নাসিরুদ্দিন নসরত শাহ তার শাসন কালে বাবরের আক্রমন থেকে আফগান নৃপতিদের আশ্রয় দেন। কিন্তু নাসিরুদ্দিন শাহ বাবর এবং আফগান লড়াইএ নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিলেন।১৫৩৮ খৃষ্টাব্দে আফগান দের হাতে হুসেন শাহী বংশের পরাজয় ঘটে এবং বাংলা দেশে আফগান শাসনের প্রতিষ্ঠা হয় । ১৫৩৯ খৃষ্টাব্দে চৌষার যুদ্ধে শের শাহের হাতে হুমায়ুনের পরাজয় হলে বাংলা দেশে আফগান শাসন পুর্ণ ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়,এই আফগান বংশা কাররানী বংশ নামে পরিচিত ছিল।
শের শাহের মৃত্যুর পরে এই কাররানী বংশের সুলতানেরা মুঘল সম্রাট আকবরের অধীনতা স্বীকার করে নেন। আর ১৫৭৪ খৃষ্টাব্দে সম্রাট আকবর শেষ কাররানী সুলতান দাউদ কাররানীকে হারিয়ে দিয়ে সমগ্র বাংলাদেশকে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত করেন। এই সময় মুনিম খান রাজধানী গৌড় থেকে টান্ডাতে নিয়ে যান।১৫৭৫ খৃষ্টাব্দে মুনিম খান এবং রাজা টোডরমল্ল এর যুগ্ম প্রচেষ্টায় বাংলাতে পুর্ণ মুঘল অধিকার প্রতিষ্টা হয়।
যদিও বাংলাতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার কথা এখানে বলা হচ্ছে তবুও ঐ সময় আফগান সুলতান শাহীর যে সমস্ত গভর্ণর ছিলেন তারা মুঘল শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইকরতে থাকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম ছিল ঈশা খান, প্রতাপাদিত্য, কেদার রায় এবং কন্দর্পনারায়নের ।ঈশাখান মুঘল দের খাজনা দিলেও কার্যত স্বাধীন ছিলেন, অন্যেরা নিজ নিজ জায়গাতে স্বাধীন ভাবেই শাসন করছিলেন। এই দলপতিরা বারো ভুইয়া নামেও পরিচিত ছিলেন।
১৫৯৪ খৃষ্টাব্দে রাজা মান সিংহ বারো ভুইয়াদের দমন করতে এলে ঈশাখানের সাথে যুদ্ধে(১৫৯৭ খৃষ্টাব্দ) তিনি হেরে যান। রাজ মান সিংহ ঈশা খানের মৃত্যুর পরে তার পুত্র দাউদ খান কে ভাটী এলাকা থেকে সোনারগাওতে তাড়িয়ে দেন। কেদার রায়কে হত্যা করা হয়। আকবরের মৃত্যুর পরে জাহাঙ্গীর বাংলার গভর্ণর হিসাবে ইসলাম খান চিস্তিকে নিযুক্ত করলে তিনি১৬০৮ খৃষ্টাব্দে এসে গৌড় থেকে তার রাজধানী ঢাকাতে সরিয়ে নিয়ে আসেন। ঢাকার নতুন নাম দেওয়া হয় জাহাঙ্গীরাবাদ।কিন্তু সাধারণ জনতা এই নতুন নাম পছন্দ করেন না, সাধারণ ভাবে ঢাকা নাম থেকে যায়। ইসলাম খানযশোহরের প্রতাপাদিত্যকে পরাস্ত করেন, এবং ঈশাখানের অন্য পুত্রকেও পরাস্ত করে বন্দী করেন। বারো ভুইয়ারা একে একে সব পরাস্ত হয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। বাংলা দেশের তদানীন্তন গরিমার প্রকাশে এই নবাবদের অবদান প্রচুর।
১৬৫৭ খৃষ্টাব্দে লাহোরের সংগ্রাম রাই যিনি মুঘলদের এক জন কর্মচারী ছিলে বর্ধমান এলাকার রাজা হিসাবে মুঘলদের কাছ থেকে ফরমান পান। তার রাজত্বের ক্রমশ বিস্তার ঘটে এবং বিষ্ণুপুরের মল্ল বংশের উপর আক্রমনে বিজয়ী হন।
ইসলাম খান চিস্তির পরে ১৭১৩ খৃশ্তাব্দে বাংলা গভর্ণর হয়ে আসেন মুর্শিদ কুলী খান। ছ বিছ্রের মধ্যে তাঁকে অড়িষ্যার দিওয়াআন নিযুক্ত করা হয়। তিনি এসে তার রাজধানী ঢাকা থেকে সরিয়ে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যান। তখনকার দিনে মুর্শিদ কুলি খান এবং সুজা খান মুঘল সম্রাটকে বার্ষিক খাজনা হিসাবে এক কোটী টাকা দিতেন।
১৭২৭ খৃষ্টাব্দে মুর্শিদ কুলী খানের মৃত্যুর পরেতার পুত্র সুজাউদ্দিন বাঙ্গলা বিহার এবং অড়িষ্যার দিওয়ান নুক্ত হন। বাংলা দেশের রাজনৈতিক অশান্তি এলে সেই সুযোগে নাগপুরের মারাঠা মহারাজা রঘুজী ওড়িষ্যার সাথে বাংলা দেশের কিছু অংশ দখল করেন।কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে মারাঠাদের বাংলা দেশ থেকে বিতারন করা হয়। এই মারাঠেদের বর্গী নামেও অভিহিত করা হয়েছে।
১৭৪০ খৃষ্টাব্দে পাটনার এক তুর্কিস্তানী সিপাহী, আলিবর্দী খান সুজাউদ্দিনের পুত্র সরফরাজ খানকে হত্যা করে মুর্শিদাবাদের নবাব হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৫৬ খৃষ্টাব্দে আলিবর্দিখানের পৌত্র সিরাজউদ্দৌল্লা নবাব হন কিন্তু আমিনচাদ বা উমিচাদ এবং মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে পলাশির যুদ্ধে সিরাজের পরাজয় হয়, বাংলা দেশে ইংরেজ শাসনের সুত্রপাত হয়।
সিরাজউদ্দৌল্লার মৃত্যুর পরে মীর জাফর তার বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার হিসাবে বাংলা দেশের মসনদে বসেন। অবশ্যি প্রতিদাব হিসাবে মীরজাফর বর্তমাণ ২৪ পরগণা এলাকা বৃটিশদের দান করেন। সাথে উপঢৌকন হিসাবেপ্রচুর ধনরত্ন ও দেওয়া হয়। ফলে মীর জাফরের আর্থিক ক্ষমতাকমে এলে বৃটিশেরা তার জামাই মীর কাশিমকে বাংলার মসনদে বসান। প্রতিদান হিসাবে তিনি বৃটিশদের মেদিনীপুর, বর্ধমান এবং চট্টগ্রাম এলাকা দান করেন।ব্রিটিশদের চাপ মীর কাশিমের উপর ক্রমাগত বাড়তে থাকায় মীর কাশিম তার রাজধানী সরিয়ে মুঙ্গেরে নিয়ে যান। এবং বৃটিশদের দেওয়া সমস্ত বানিজ্যিক অধিকার বন্ধ করে দেন। বৃটিশেরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে এবং পাটনা অধিকার করে। মিরকাশিম পাটনা পুনরায় অধিকার করলেও পরে বৃটিশদের সাথে ঘরিয়া, উরানওয়ালা এবং মুঙ্গেরের যুদ্ধে মীরকাশিমের পরাজয় হয়। মীর কাশিম পালিয়ে গিয়ে অযোদ্ধাতে আশ্রয় নেন।১৭৬৪ খৃষ্টাব্দেরঅযোদ্ধার নবাব সুজাউদ্দৌল্লা, বাংলার নবাব মীর কাশিম এবং মুঘল বাদশা দ্বিতীয় শাহ আলমের সাথে বৃটিশদের বক্সারের যুদ্ধে বৃটিশেরা জয়ী হন। ফলে বাংলা দেশে যেটুকু নবাবী শাসন ছিল তার অবসান হয় এবং ইংরেজ কতৃত্ব পুর্ণ ভাবে শুরু হয়ে যায়।
কিন্তু বৃটিশদের এক নবাবের নামের দরকার ছিল কেননা তারা তখন আইনত ব্যবসাদার হিসাবেই ছিল। মীরকাশিমের পরে কে মসনদে বসবে তা ঠিক করতে কোম্পানি এক সভা ডাকে সেখানে দাবীদার থাকে দুজন, এক মীরণের শিশুপুত্র আর দ্বিতীয় মীরকাশিমের দাসী পুত্র। বৃটিশেরা মাত্র পাঁচ মিনিটের বৈঠকের মধ্যে স্থির করে নেয় যে মীরকাশিমের দাসীপুত্র সুজা কে মসনদে বসান হবে। আর তাঁর কাজ কর্ম দেখাশুনা করার জন্য কোম্পানির তরফ থেকে আসে মহম্মদ রেজা। মহম্মদ রেজা এই সময় মহারাজ নন্দকুমারের থেকে বৃটিশদের কাছে বেশী প্রিয়পাত্র ছিলেন। বার্ষিক বেতন মহম্মদ রেজার জন্য নির্ধারিত হয় সোয়া লক্ষ পাউন্ড। এটুকু মনে রাখলেই হবে যে মুঘল সম্রাটকে বার্ষিক সাড়ে তিন লাখ পাউন্ড দেওয়া হত পেন্সন হিসাবে।
এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার যে যদিও আমরা ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসনের কথা বলি, কিন্তু সেই সময় ইউরোপ থেকে বিভিন্ন দেশের বণিকদল এসে তাদের ব্যবসার জন্য বাংলাদেশে তাদের কুঠি স্থাপনা করে এবং পরে সেই কুঠিগুলি তাদের রাজ্যের কেন্দ্র হিসাবে কাজ করতে থাকে। ফরাসীরা এসে তাদের কেন্দ্র বানায় চন্দননগরে, ওলন্দাজেরা বানায় চুচুড়াতে এবং পর্তুগীজেরা বানায় হুগলীতে। এদের মধ্যে চুচুড়া ১৭৯৫ খৃষ্টাব্দে ফ্রান্সের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে বৃটিশেরা অধিকার করে ।
হুগলিতে ১৫৮০ খৃষ্টাব্দ নাগাদ পর্তুগীজ ব্যবসায়ীরা আসেন। পর্তুগীজদের ব্যবসার সাথে আর এক প্রধান কাজ ছিল ধর্মান্তকরন। সেই সময় তাদের এই ধর্মান্তকরন এত বেশী কার্যকরী ছিল যে এটা জানা যায় যে সারা বাংলাতে যখন প্রায় ২০ হাজারের মত খৃষ্টান ছিলেন সেখানে শুধুমাত্র হুগলীতেই প্রায় দশ হাজারের মতন খৃষ্টধর্মালম্বী ছিলেন। ব্যান্ডেলের বিখ্যাত চার্চ পর্তুগীজদের তৈরী। ব্যান্ডেল পরে বৃটিশদের অধিকারে চলে আসে। খালি ভারতের স্বাধীনতা পর্যন্ত চন্দননগরে ফরাসি শাসন ছিল এবং বিপ্লবীরা এই এলাকাতে এসে আত্মগোপন করতেন।
রবার্ট ক্লাইভ ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে তার দ্বিতীয় বারে ভারতে আগমনের পরে অযোদ্ধার নবাব এবং মুঘল বাদশার সাথে এলাহাবাদে এক সন্ধি করেন যাতে বাংলা বিহার এবং ওড়িষ্যার প্রকৃত শাসনভার ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায়, বাদশারা খালি এক পেন্সনের মত টাকা কোম্পানির কাছ থেকে পেতে শুরু করেন।
এই সময় বাংলা দেশে জমিদারদের প্রত্যেক বছর এক নীলামের মাধ্যমে বন্দোবস্ত দেওয়া হত। নাম ছিল পুনিয়া। এই প্রথাতে যে জমিদার সব চেয়ে বেশী দাম বলার ক্ষমতা রাখত সেই জমিতে চাষ করার অধিকার পেত। তার অবশ্যম্ভাবী ফল ছিল গরীব চাষীকে প্রায় বিনা মজুরীতে কাজ করতে হত। দেনার দায়ে কৃষক ঘর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে কি আত্মহত্যা করেছে এই রকম অবস্থা প্রচুর ছিল।
১৭৭০ খৃষ্টাব্দে বাংলাদেশে অনাবৃষ্টির ফলে কোন রকম চাষ আবাদ হয়না। গ্রামের লোকে না খেতে পেয়ে শহরের দিকে আসতে শুরু করে। অনাহারে লোকের মৃত্যু শুরু হয়ে যায়। এটা মনে করা হয় যে গ্রামগঞ্জে প্রায় আদ্ধেক লোকে অনাহারে মারা গেছিল। এক ইতিহাস লেখকের মতে কলকাতা শহরে একশ লোক লাগানো হয়েছিল মৃতদেহ তুলে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেবার জন্য। এটা অতিশয়োক্তি হলেও এই দুর্ভিক্ষে বাংলার জনসংখ্যা প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। এটাই সেই বিখ্যাত ৭৬ এর মন্বন্তর যাতে অনুমান করা হয় প্রায় এক কোটির মত লোকে মারা গিয়েছিল। কিন্তু কোম্পানির তরফে লোকের দুর্দশা দূর করার কোন প্রচেষ্টাছিল না। বরং তারা ব্যবসার খাতিরে প্রথমে নুনের ব্যবসায়ে ট্যাক্স দ্বিগুন করে দ্যায়। নুনের ব্যবসা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। উত্তর ভারতে সন্ধব লবন আর করকচের ব্যবহার চালু হয়ে যায়। সুপারী এবং তামাকের ব্যবসা মনোপলি করে কারুর কাছে তামাক বা সুপারী পাওয়া গেলে তাকে শাস্তি দেবার বন্দোবস্ত করা হয়।
এই ১৭৭০ খৃষ্টাব্দে জলপাইগুড়ি এবং মুর্শিদাবাদ জেলাতে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ হয় যেটা প্রায় ১৮০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত চলতে থাকে। যদিও এটাকে ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামের এক অধ্যায় বলে ধরা হয় তবুও কিছু ঐতিহাসিক এটা মুলত লুঠেরা সন্ন্যসী এবং বৃটিশ ফৌজের মধ্যে লড়াই বলে মনে করেন। এটা মনে রাখতে হবে এই সময়ে মন্বন্তরের ফলে দেশে লোকজন বিশেষ ছিল না। ফৌজ তাদের যুদ্ধ কৌশল দেখানোর সুযোগ পেয়েছিল, তা সত্বেও প্রায় ত্রিশ বছর লেগে গিয়েছিল এদের দমন করতে। এই সন্ন্যাসীরা ছিল উত্তর ভারতীয় এবং নাগাসম্প্রদায়ের লোক।
১৭৭০ সালেই বাকুড়া এবং মেদিনীপুর অঞ্চলে চুয়ার সম্প্রদায়ের লোকেরা বিদ্রোহ করে। নেতৃত্ব দেন দুর্জন সিং। জমিদার শ্রেণী এবং মহাজনদের অত্যাচারের সাথেকোম্পানির আমলাদের যোগসাজশের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ হয়। প্রথমে দুর্জন সিং এর নেতৃত্বে ১৭৯০ পর্যন্ত এবং আবার ১৭৯৯ থেকে ১৮১৬ পর্যন্ত অঞ্চল সিং এর নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ চলে। শেষের দিকে কোম্পানির সৈন্যদলের সাথে এদের চোরাগোপ্তা গেরিলা নীতির লডাইএ কোম্পানির সৈন্যদের পেছতে হয়। কিন্তু পরে শালবনী অঞ্চলের জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে এদের লুকোনর জায়গার অভাব করে দিলে শেষ পর্যন্ত এদের পরাস্ত হতে হয়।
মুলত কোম্পানি ভারতবর্ষে ব্যবসার জন্য মুঘলদের কাছ থেকে ফরমান পেয়েছিল। এবং লন্ডনের ডিরেক্টরেরা তাই জানতেন এবং ভাবতেন। কোম্পানীকে তাদের ব্যবসার জন্য কিন্তু ইংল্যান্ডে ট্যাক্স দিতে হত। ক্লাইভের সময় থেকেই দেখা যায় যে কোম্পামীর প্রতিনিধিরা তাদের নিজের ব্যবসা চালু করে দিয়েছেন এবং বেআইনি ভাবে তাদের নিজস্ব সম্পত্তির পরিমাণ বাড়িয়ে চলেছেন।
১৭৭০ খৃষ্টাব্দে বাংলা দেশে লুই বোণার্ড প্রথম নীল গাছের চাষ শুরু করেন। নীল রঙের চাহিদা পুরো ইউরোপ জুড়ে ছিল কেননা সেটা সাধারণত পুরাতন প্রথাতে প্রাণিজ উৎপাদন ছিল। কিন্তু নীল গাছের প্রধান অসুবিধা ছিল যে বর্তমান ইউল্যালিপটাস গাছের মত জমির উর্বরা শক্তি কমিয়ে দিত কাজেই প্রত্যেক বছর একই পরিমাণ উৎপাদনের জন্য অধিক জমিতে চাষ করতে হত। বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী এই নীল চাষের জন্য গরীব কৃষকদের প্রথমে টাকা ধার দিয়ে তাদের হাতে আনতে থাকেন। এই ধার দেওয়ার ব্যবস্থাকে বলা হত দাদন দেওয়া। কিন্তু অনেক বেশী সুদের হার হবার ফলে কৃষকেরা একবার এই ঋনের কবলে পড়লে প্রায় ক্রীতদাস হয়ে যেত। নীল চাষ করার জন্য এবং তার ফসল গুদামজাত করার জন্য জায়গায় জায়গায় নীলকুঠি তৈরী হল। হেষ্টিংসের সময় পার্লামেন্টে এই অত্যাচার নিয়ে হেষ্টিংসের বিরুদ্ধে প্রস্তাব এলেও সেটা কিন্তু পাশ হয় নি কারণ যারা এই সম্বন্ধে বলবার তাদের প্রায় প্রত্যেকের এই ব্যপারে নিজস্ব স্বার্থ ছিল।
হেষ্টিংসের পরে আসেন লর্ড কর্ণওয়ালিশ। এর আগেই বৃটিশদের সাম্রাজ্য বিস্তার বাংলা থেকে সরে গিয়ে দাক্ষিণাত্যে চলে যায়। বৃটিশদের শাসন ব্যবস্থা তিন প্রেসীডেন্সীতে সীমাবদ্ধ থাকে। (১) কলকাতা প্রেসীডেন্সী (২) মাদ্রাজ প্রেসীডেন্সী এবং বম্বে প্রেসীডেন্সী। ক্লাইভের পরেই কলকাতা প্রেসীডেন্সীকে প্রাধাণ্য দেওয়া হতে থাকে, এবং কোম্পানি মুল প্রতিনিধি কলকাতায় বসে গভর্ণর জেনারেল নামে বৃটিশদের স্বার্থের দিকে নজর রাখতে শুরু করেন।
আগেই বলেছি জমিদারদের প্রত্যেক বছরে নীলামের মারফত চাষ করার পাট্টা নিতে হত যেটা রায়তয়ারী বা মহালয়ারী বলে জানা যেত। অবশ্যি তার নাম ছিল পুনিয়া। কর্ণওয়ালিশ এসে এই ব্যবস্থাকে বদল করে দেন। ১৭৯০ খৃষ্টাব্দে তিনি এটাকে প্রথমে দশ বছরের জন্য ব্যবস্থাতে রূপান্তরিত করেন। পরে ১৮০০ খৃষ্টাব্দে তিনি জমিদারদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্যে নিয়ে আসেন। এতে জমিদারদের একটা স্থিতি এলে চাষীদের দুর্গতি কিছুটা কমে।
কিন্তু কর্ণওয়ালিশের পরে ওয়েলেসলি এসে তার সম্প্রসারণ নীতি দিয়ে বৃটিশদের সাম্রাজ্য বিস্তারে মন দেন।তার বশ্যতামূলক সন্ধি বা মৈত্রী নীতির জোরে তার কথা অনুযায়ীদেশীয় রাজন্যদের থাকতে হত। অমৃতসরের সন্ধিতে এরই জোরে পাঞ্জাবের মহারাজাকে তার কাশ্মীর অঞ্চল ডোগরাদের বিক্রী করতে বাধ্য করা হয়।ওয়েলেসলীর পরে আসেন ডালহৌসি। তিনি তারবিখ্যাত ডকট্রিন অফ ল্যাপ্স এর জোরে অপুত্রক রাজাদের দত্তক নেওয়া বন্ধ করে সেই রাজ্য বৃটিশদের অধিকারে নিয়ে আসা শুরু করেন। সিপাহী বিদ্রোহ বা ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ এখানেই শুরু হয়।
১৮৩৩ খৃষ্টাব্দেএক আইনের জোরে ভারতীয় কৃষকদের উপর নীলকর, জমিদার এবং মহাজনদেরঅত্যাচার প্রায় আইনসিদ্ধ করে নেওয়া হল। নীলকরেরা কৃষকদের ধান তামাক ইত্যাদি চাষ করার বদলে নীল চাষ করতে বাধ্য করা শুরু করল। নদীয়া, বীরভূম, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, যশোহর, পাবনা এলাকাতে অন্য চাষ প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।
No comments:
Post a Comment